চট্টগ্রামের স্কুলশিক্ষক মৌলানা সৈয়দ মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন সিদ্দিকির ৬ সন্তানই মেয়ে। এ নিয়ে আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা নানা কথা বললেও মেয়েদের নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না তার। স্কুলে শিক্ষকতা করে পাওয়া অর্থ দিয়ে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি।
মেয়েদের নিয়ে বড় বড় স্বপ্নের কথা বলতেন আলতাফ হোসেন। সেই স্বপ্নে রাঙিয়ে দিতেন কন্যাদের।
চাকরির সুবাদে মেয়েরা ছোট থাকা অবস্থাতেই নিজ এলাকা ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভা ছাড়তে হয় তাকে। পুরো পরিবার নিয়ে ছুটেছেন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা। তবে মেয়েদের পড়ালেখায় ক্ষতি হতে দেননি একবিন্দু।
মেয়েরা বড় হতে থাকলে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা তাদের জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসতে শুরু করেন। কিন্ত নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি আলতাফ হোসেন। তার ভাষ্য, ‘মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, মানুষের মতো মানুষ হবে।’ এ নিয়েও আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীদের আপত্তির শেষ ছিল না। অবশ্য সেসব কখনও গায়ে মাখেননি মৌলানা আলতাফ। বরং মেয়েরা যেন কারও কথায় কখনও স্বপ্নচ্যুত না হয়, সেই চেষ্টাই করতেন তিনি।
২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আলতাফ হোসেনের মৃত্যু হয়। তবে তার স্বপ্ন আর সংগ্রাম বৃথা যেতে দেননি তার মেয়েরা।
আলতাফ হোসেনের দুই মেয়ে সৈয়দা ফাতেমা সিদ্দিকা ও সৈয়দা জান্নাতুন নাঈম রানী ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
তাদের ছোট দুই বোন সৈয়দা ইসরাত জাহান সিদ্দিকা ও সৈয়দা তানজিনা সিদ্দিকা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। পাশাপাশি বিসিএসের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
ছোট দুই বোনের মধ্যে সৈয়দা রাহিমা সিদ্দিকা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) শেষবর্ষে পড়ছেন। সবচেয়ে ছোট সৈয়দা নিশাত সিদ্দিকা পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অর্থনীতি বিভাগে।
জান্নাতুন নাঈম অবশ্য ৪০তম বিসিএসেই ক্যাডার হিসেবে (শিক্ষা) সুপারিশপ্রাপ্ত হন। সেবারই প্রথম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে ২০১৫ সালে স্নাতক ও ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে ফের সুপারিশপ্রপ্ত হন জান্নাতুন, এবার তার সঙ্গে সুপারিশপ্রাপ্ত হন বড় বোন ফাতেমা সিদ্দিকাও। তবে ফাতেমা ৪১তম বিসিএসেই প্রথমবার অংশগ্রহণ করেন তিনি। সে হিসেবে দুই বোনই প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
ফাতেমা সিদ্দিকার পড়াশোনা চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে। ২০১৪ সালে বাংলায় স্নাতক ও পরের বছর একই কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
স্বপ্ন ছুঁয়ে জান্নাতুন নাঈম বলেন, ‘আমরা ৬ বোন একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। আর্থিক টানাপোড়ন থাকলেও আমাদের কখনও বুঝতে দেননি বাবা। সবার আগে আমাদের পড়াশোনাকে আগ্রাধিকার দিতেন তিনি। আমরা প্রথম তিন বোন ২০১৮ সালে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম। তখন বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আমার ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষণার ১০ দিন আগে তিনি আমাদের ছেড়ে যান। উনি আমাদের সফলতা দেখে যেতে পারেননি, তবে আমাদের বিশ্বাস- উনি আমদের সঙ্গেই আছেন।’
ফাতেমা সিদ্দিকা বলেন, ‘আব্বু-আম্মু দু’জনই পড়াশোনা জানা মানুষ হওয়ায় আমরা শিক্ষার পরিবেশটা পেয়েছি। পরিবারে আমাদের পড়াশোনাটাই সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) পেত। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলতেন। আব্বুকে এসে বলতেন- আপনারা তো বয়স্ক হয়ে গেছেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়েদের কে দেখবে? তখন আমার বাবা বলতেন- আমার মেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হবে। তারা নিজেরাই নিজেদের দেখবে, দেশ ও দশের জন্য কাজ করবে।’
‘মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল আলতাফ হোসেনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল’ বলে জানান তার স্ত্রী সৈয়দা কুলসুমা আকতার। তিনি বলেন, ‘তখন কীভাবে যে মেয়েদের নিয়ে এত কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি, এখন পেছনে তাকালে অবাক লাগে। তাদের বাবার একমাত্র স্বপ্নই ছিল- মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করা। রক্ষণশীল পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনা করতে দেয়া হয় না বলে ধারণা অনেকের। কিন্তু ওদের বাবার মৌলানা ছিলেন। উনি তো সবকিছু জানতেন। উনি বলতেন- শালীনতার মধ্যে থেকে জ্ঞানার্জনে কোনো বাধা নেই। আমার মেয়েরাও অনেক মেধাবী ছিল। তারা সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় বৃত্তি পেত।’
সৈয়দা কুলসুমা বলেন, ‘একসময় আমাদের মেয়েদের নিয়ে যারা নেতিবাচক কথা বলত, তারা এখন তাদের নিয়ে গর্ব করে। তাদের ধারণ করে। এখন অনেকেই বিশ্বাস করে যে, মেয়েরা চাইলেই অনেক কিছু পারে।’
মৌলানা আলতাফ হোসেনকে উদ্ধৃতি করে তিনি বলেন, ‘উনি বলতেন- আমার এই ছয়জন মেয়ে বলে কী হয়েছে? তারা মানুষ হলে ছেলেদের চেয়েও বেশি কিছু। আমার ছয়জন মেয়ে নয়, তারা আমার রত্ন।’
স্থানীয় কাউন্সিলর মো. আমান উল্লাহ বলেন, ‘উনি একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। উনার কোনো ছেল ছিল না, মেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করেছেন। আগে তার প্রথম চার মেয়ে প্রাইমারির শিক্ষক ছিলেন। এখন বড় দু’জন বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। ছোট দু’জনও ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। তারা আমাদের এলাকার গৌরব। নারী শিক্ষায় একটা দৃষ্টান্ত এটা।’