পাট কে বাংলাদেশের সোনালী আঁশ বলা হয়। ছোটবেলায় বই এর পাতায় বাংলা ইংরেজী রচনা পড়তে গিয়ে এই বাক্যগুলোর দ্বারাই প্রথম আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্য পাটের গুরুত্ব জানতে পেরেছিলাম।
আর সৌভাগ্যক্রেমে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার ব্রক্ষ্মপুত্র তীরবর্তী এক গ্রামে আমার দাদাবাড়ি থাকায়, সেখানে কেটেছে আমার ছোটবেলা, আর তাই পাটশিল্পের সেই স্বর্ণালীযুগের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম আমি কিছুটা হলেও। পাটের সিজনে আমাদের গ্রামজুড়ে দেখা যেত উৎসবমুখর পরিবেশ, তবে বাতাস ভারী হয়ে যেত পাট জাগ দেয়ার তীব্র গন্ধে। তারপরও যখন রচনায় পড়া সেই লাইনগুলোর কথা মনে পড়ত যে, এই পাটই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি , এই পাট এবং পাটজাতদ্রব্য রপ্তানী করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, ঠিক তখন পাট পচা গন্ধটাও মধুর লাগত।
পাট জাগ দেয়া হয়ে গেলে যখন পাটকাঠি থেকে একে আলাদা করে ফেলে রোদে শুকিয়ে পুরোপুরি তৈরী করা হত বিক্রির জন্য, ঠিক তখনই কিছু লোক ঘোড়া নিয়ে এসে হাজির হত, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখতাম ঘোড়াগুলো এসে পাট বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় মহিলাদেরকে দেখতাম তখন হাড়ি পাতিল টানিয়ে রাখার জন্য সিকা তৈরী করত, কেউ বা পাটকাঠি দিয়ে বানাত কোনো শিল্পকর্ম। এই দৃশ্যগুলো দেখতে খুব ভালো লাগত আমার, এখনো সেই দৃশ্যপট ভেবে বেশ ভালো লাগছে। হয়ত গ্রামীন এই দৃশ্যের সাথে আরও অনেকেই পরিচিত। এক সময়ের প্রধান অর্থকরী শস্য এই পাট আমাদের অস্তিত্বের সাথেই অনেকাংশে মিশে আছে।
আমাদের ময়মনসিংহ অঞ্চল পাটশিল্প তথা পাট উৎপাদন, পাটজাত দ্রব্য তৈরী এবং বিপণনের জন্য সব সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটা অঞ্চলের মাঝেই ছিল এবং এখনো আছে। যদিও পলিথিন ব্যাগ আসার পর আমাদের দেশের পাটশিল্পের সোনালি সময়ে কিছুকাল ভাটা পরেছিল, কিন্তু পরিবেশ বান্ধব বলে আবারও এই পাটশিল্পের নবজাগরণ আরও বড় পরিসরে ঘটানো সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে ময়মনসিংহ বিভাগকে ক্ষতিকারক পলিথিনমুক্ত ঘোষণা করা ফলে নিত্য ব্যবহার্য্য পলিথিনের বিকল্প খুঁজছে সাধারণ মানুষ। ফলে একদিকে পলিথিনের বিকল্প, অন্যদিকে প্রয়োজনের তাগিদে ময়মনসিংহে পাটের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন বাজারে গেলে মানুষজন হাতে করে একটা পাটের তৈরি চটের ব্যাগ নিয়ে যেতো। কিন্তু আশির দশকে বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শুরুর ফলে চটের ব্যাগ তথা পাটদ্রব্যের ব্যবহার একদমই কমে যায়।
এই পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশের জন্য এতটাই বিপর্যয় ডেকে আনে যে, সরকার বাধ্য হয়ে ২০০২ সাল থেকে এর উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহারকে আইন করে নিষিদ্ধ করে। ফলে কিছুদিন পলিথিনের ব্যবহার কিছুটা কম ছিলো। কিন্তু এই আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণে আবারো ব্যাপকভাবে দেশজুড়ে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পলিথিন ও প্লাস্টিক এমন একটি পদার্থ যার আয়ুষ্কাল কয়েক হাজার বছর। যা মাটিতে গেলে ক্ষয় হয় না বা মাটির সাথে মেশে না। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পায়। এছাড়াও মাটিতে প্লাস্টিকের টক্সিক রাসায়নিক পদার্থ গাছে মিশে যাচ্ছে। যা পশু পাখি ও মানুষের শরীরেও এসে পৌছায়। ফলে মানুষের শরীরে অনেক মরণব্যাধিসহ ক্যান্সার হয়ে থাকে। পলিথিনের এসব ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এবং পলিথিন নিষিদ্ধের আইন বাস্তবায়নের সরকার বেশ কয়েকটি খাতে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পাট জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায়ই ময়মনসিংহ বিভাগকে পলিথিনমুক্ত ঘোষণা করেছে বিভাগীয় প্রশাসন। এই লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আর তাই বর্তমানে পাটের বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় পাটচাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন ময়মনসিংহের চাষিরা।
শুধু বাজারের চটের ব্যাগই নয়, যেকোনো শপিং মলে দেখা যাবে নারীদের জন্য হাল ফ্যাশনের পাটের ব্যাগ, করপোরেট অফিসে নিত্য ব্যবহারের জন্যও আছে দামি পাটের ব্যাগ। আর পাটের আঁশ কিছুটা গরম বলে শীতের পোশাক হিসেবে বেশি ব্যবহার হচ্ছে, পাটের আকর্ষনীয় শাড়ি,সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জবি, শোপিস, ওয়ালমেট, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, শিকা ও সুতা তৈরী হচ্ছে।
এমনিভাবে ময়মনসিংহে এখন আবারও পাটের নানা পণ্যের সমাহার দেখা যাচ্ছে। তৈরি হয়েছেন অনেক নতুন উদ্যোক্তা। তারাই এখন তৈরি করছেন আকর্ষণীয় সব পাট পণ্য। সৌখিন ক্রেতারা ঘর সাজাতে এসব পণ্যের ব্যবহার করছেন, এইসব নানারকম পাটে তৈরী শো-পিছ এখন সৌখিন লোকদের বাড়ির ড্রইং-ডাইনিং রুমে ব্যবহৃত হচ্ছে। চাহিদা তৈরি হওয়ায় কিছু উদ্যোমী নারী উদ্যোক্তা এসব পণ্য তৈরি ও বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।
জাতীয় অর্থনীতিতেও বর্তমানে পাটশিল্পের অবদান বাড়ছে, পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করে আবারও প্রচুর বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন করছে দেশ। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য মতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৪৩ দশমিক ৮৭ কোটি ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আর তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি।
পাট মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাট চাষ নিশ্চিতকরণে বীজ সরবরাহ সঠিক রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার মানসম্মত পাটের উৎপাদন বাড়ানো ও পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে পাট অধিদফতরের আওতায় ‘উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি দেশের ৪৬টি জেলার ২৩০টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাটচাষের উন্নত কলাকৌশল সম্পর্কে চাষিদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। এছাড়াও গুণগত মানসম্মত পাট ও পাটবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের ৩৯০ মেট্রিক টন পাট বীজ বিনামূল্যে বিতরণসহ সবধরণের সহায়তা অব্যাহত রয়েছে।
সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বিবেচনায় পাট চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি পাট শিল্পের সম্প্রসারণে সবধরনের সহায়তা দিচ্ছে। পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করার লক্ষ্যে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন,২০১০’, ‘পাট আইন,২০১৭’, ‘জাতীয় পাটনীতি,২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে । এ সব আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাট খাত থেকে রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ আসে পাটজাত পণ্য থেকে যা ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানাসহ আরো কিছু দেশে রপ্তানি করা হয়। এছাড়াও খাদ্য হিসেবে পাটের উপযোগিতাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কচি অবস্থায় পাটের পাতা আমাদের দেশে বেশ উপাদেয় শাক হিসেবে পরিচিত। শুকনো পাট পাতা অর্গানিক চা উৎপাদনও শুরু হয়ে গেছে। এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় এই পানীয় মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ববাজারে তার পরিচিতি তুলে ধরতে পারলে তা চায়ের বিকল্প সারাবিশ্বেই জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে।
আমাদের দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে পাট শিল্পের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এই শিল্পই আমাদের অর্থনীতির চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকের অবলম্বন এই পাট। কর্মসংস্থান, অর্থ উপার্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বোপরি এই দেশের ঐতিহ্য ও নিজস্বতা রক্ষায় পাট শিল্পের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আধুনিকতার পদতলে নিষ্পেষিত যখন পুরো পৃথিবী, দূষণের ফলে বিশ্ব পরিবেশ যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তখন পাট শিল্পের যথাযথ ব্যবহার আমাদের বাঁচাতে পারে অদূর ভবিষ্যতের অনেক ভয়াবহতা থেকে। এ শিল্প আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এ শিল্প বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পরিচায়ক। সরকারের সজাগ দৃষ্টি ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে হবে আমাদের এই শিল্পকে এবং ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য, নিজস্বতার ধারক এই পাট শিল্পকে।
আর বর্তমানের এই কোভিড সিচুয়েশনে যখন নাজেহাল বিশ্ব অর্থনীতি, তখন সবকিছুতেই বাড়ছে ই-কমার্সের ছোঁয়া। ই-কমার্স মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ করে দেয়ার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ব্যবসায় বাড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহন। আমাদের শহরেও অনেক নারী এখন পাটজাত দ্রব্য তৈরী ও বিপণন করছে।
আমাদের ময়মনসিংহ সদরের একজন পাটজাতদ্রব্যের উদ্যোক্তা হাফিজা আক্তার রানী, উনি পাট দিয়ে লেডিস ব্যাগ,স্কুল ব্যাগ থেকে শুরু করে পাট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শোপিচ বানিয়ে থাকেন আবার পাটের বুনন করে টেবিল ম্যাট,পাপোশ, দোলনা ইত্যাদিও তৈরি করেন। আর সব থেকে মজার ব্যাপার যা জানতে পারলাম, পাটপন্য দিয়ে কিনা অসাধারন স্টেজ ডেকোরেশন করা যায় এবং ক্ষুদ্র এই পাটশিল্পের উদ্যোক্তারা মুক্তাগাছায় তাদের একটা প্রোগ্রামের স্টেজ ডেকোরেশন করেছিল পুরো পাটপন্য দিয়ে।
ময়মনসিংহের এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরকে যদি ই-কমার্সের আওতায় আরও বড় পরিসরে আনা যায় এবং সঠিক ভাবে ইউনিক সব পাটপন্যগুলোকে এফ-কমার্সের মাধ্যমে পরিচিত করা যায়, তবে তাদের তৈরী করা আকর্ষনীয় সব পাটপণ্যগুলোকে পুরো দেশ এবং বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া যাবে খুব সহজেই। এতে আমাদের জেলার উন্নয়নের পাশাপাশি পুরো দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতেও সহায়তা করবে।