খাতুনে জান্নাত আশা, ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম টিভি// চা শব্দটা শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে দেশের চা এর রাজধানী খ্যাত সিলেট এবং এর পাহাড়ি অঞ্চলের সবুজঘেরা বিশাল বিশাল চা বাগানের চিত্র। আবার অনেকে হয়ত চট্টগ্রাম, বান্দরবন আর পঞ্চগড়েও চা চাষ হয় বলে জেনে থাকবেন, তবে ময়মনসিংহেও যে চা এর চাষ হচ্ছে এই ব্যাপারটা এখনো অধিকাংশের অজানাই বটে! ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে খুব বড় পরিসরে চা চাষ হচ্ছে তা বলা যাবে না, তবে ক্ষুদ্রায়তনে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে হচ্ছে চা এর আবাদ; আর তা কিনা বাড়ির পাশের অনাবাদি পতিত জমিগুলোকে ব্যবহার করেই!
বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী এতো বছর আমরা জেনে এসেছিলাম, চা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হল প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উঁচু ভূমি; যেন বৃষ্টি হলেও দ্রুত পানি নিষ্কাশন হয়ে যায়। এ কারণে এতোদিন চা চাষের জন্য পাহাড়ি উঁচু ভূমিই বেছে নেয়া হতো। তবে পাহাড়ি এলাকায় এতো বছর চা চাষ হয়ে এলেও ২০০০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলায় ছোট ছোট বাগানে সেরা মানের চা চাষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আর সমতল ভূমিতে উৎপাদিত এই চা, বাংলাদেশে চায়ের মোট চাহিদা পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে, আর এজন্যই চায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ময়মনসিংহ বিভাগের কয়েকটি জেলা উপজেলায় চা চাষের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে চা উন্নয়ন বোর্ড, এছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও কেউ যদি ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষ করতে চাইলে উদ্বুদ্ধ করছে তারা বলে জানান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটঃ
ব্রিটিশদের হাত ধরে দেশে বানিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৫৪ সালে মতান্তরে ১৮৪৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায়। তৎকালীন সময়ে দেশের জনসাধারণের কাছে চা একটি অচেনা সাহেবী পানীয় বলেই পরিচিত ছিল। তাই দেশে উৎপাদিত চা এর প্রায় পুরোটাই বিদেশে রপ্তানী করা হত। পাটের পর চা ই ছিল দেশের প্রধান রপ্তানীযোগ্য পণ্য।
কিন্তু ধীরে ধীরে চা কে এদেশের মানুষ এতোটাই আপন করে নিয়েছে যে, এটি এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়’র একটি। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত- সমাজের কোনো স্তরের বাঙালিরই সকাল সন্ধ্যা এখন চা ছাড়া কাটতে চায় না যেন, বাঙালির আড্ডায় অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ এখন এই চা!
ফলে দেশে তাই চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় উৎপাদন যেমন বাড়ানো হয়েছে তেমনি রপ্তানিও কমানো হয়েছে অনেকখানি। কিন্তু এরপরও প্রতিবছর চাহিদার তুলনায় ১ থেকে ২ কোটি কেজি চায়ের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এই ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি তাই রপ্তানি স্বাভাবিক গতিতে ফেরাতে ২০২৫ সাল নাগাদ চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ কোটি কেজি নির্ধারণ করেছে সরকার এবং সমতল ভূমিতে ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে চা উন্নয়ন বোর্ড। চা চাষে আগ্রহীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষন এবং মূলধন ব্যবস্থা প্রদান করেও সাহায্য করছে তারা। এরই অংশ হিসেবে ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার শ্রীবরদি, ঝিনাইগাতী, নকলা, নালিতাবাড়ি, জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলায় এবং ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায় ৫ দশমিক ৩১ একর জমিতে ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ করা হচ্ছে। এছাড়াও চা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ গারো পাহাড় অধ্যুষিত শেরপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন জায়গা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আরও কিছু সংখ্যক এলাকায় চা চাষের সম্ভাবনা দেখছেন, আর চা চাষে অনুপযোগী জমিকেও উপযোগী করে তৈরী করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়ার কথা ভাবছেন। তাদের পর্যবেক্ষন অনুযায়ী, ময়মনসিংহের ১৫ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ সম্ভব এবং এই জমিগুলোকে কাজে লাগিয়ে বছরে ১৬ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছেন।
ইতোমধ্যেই চা বোর্ড ৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে এক হাজার ২৩৫ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ করতে “ময়মনসিংহ বিভাগে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প” শিরোনামে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ থেকে ১ দশমিক ৫০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হবে এবং ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের চা চাষীদের সাফল্যগাঁথাঃ
ঘটনা ১-
এটি ২০১১ সালের গল্প। শেরপুরের নকলার অধিবাসী রোকন উদ্দিন সাগর বেড়াতে গিয়েছিলেন লালমনিরহাটে, আর শখের বশে নিয়ে আসেন বেশ কয়েকটি চা গাছের চারা। বাড়ির আঙিনায় এনে রোপণ করার পর যখন দেখেন গাছগুলো বেশ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে ঠিক তখনই তার মাথায় খেলে যায় বানিজ্যিকভাবে চা চাষের চিন্তা। আর তাই পরের বছর পঞ্চগড় থেকে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে সাত হাজার চারা কিনে এনে আড়াই একর জমিতে রোপণ করেন। প্রাথমিক ধারণা নিয়েই তিনি পরিচর্যা শুরু করেন এই চা-বাগানের আর এর দুবছর পর তিনি কিছু কচি পাতা তুলে চা তৈরি করে পরখ করে দেখলেন স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই চা পাতা। এই দেখে তিনি বাগানের প্রতি আরও যত্নশীল হয়ে উঠেন। বর্তমানে তার চা বাগানে ৭জন শ্রমিক কাজ করেন এবং তিনি নিজ উদ্যোগে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিষাক্ত রং ও ঔষধ ছাড়াই চা উৎপাদন করে “সাগর চা” নামে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করছেন প্রতি কেজি চা পাতা ২৩০-২৫০ টাকা দরে।
ইতিমধ্যে সাগর চা বেশ সুনামও কেড়েছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলা থেকে জেলাতে।আর তাই তার থেকে অনুপ্রানিত হয়ে আরও অনেকেই চা চাষে ঝুঁকতে শুরু করেন।
ঘটনা ২-
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার ঘোগা ইউনিয়নের বিজয়পুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আবুল হাশিম একজন কৃষক হিসেবে সব সময় ভিন্ন ধরণের কিছু করতে চাইতেন। পঞ্চগড়ে থাকতেন হাশিমের চাচা, যিনি চা চাষ করে বিপুল সফল হয়েছিলেন। চাচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পঞ্চগড় থেকে চারা সংগ্রহ করে ২০ শতক জমিতে ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিলে এক হাজার চারা নিয়ে সমতলের এ অঞ্চলে পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরু করেন আবুল হাশিম। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে জমির মাটির উপযোগিতা পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর চায়ের চাষাবাদ শুরু করেছিলেন তিনি। আর বছর না পেরুতেই চা গাছের ঈর্ষণীয় বিকাশে আরও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি এবং তাকে দেখে সেই অঞ্চলের আরও কৃষকরা চা চাষ শুরু করেছেন বর্তমানে।
তবে উক্ত এলাকায় চা পাতা প্রসেসিং করার কোনো কারখানা না থাকায় বাজারজাত করণে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চা চাষীরা। কারখানা স্থাপন করা হলে উৎপাদিত চা পাতা বাজারজাত করে প্রচুর লাভবান হতে পারবেন বলে মনে করেন তারা।
ঘটনা ৩-
শেরপুরের একজন উদ্যোক্তা মো. আমজাদ হোসেন, যিনি “গারো হিলস টি কোম্পানি” নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনিই প্রথম শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীতে গারো ও হাজং জাতিসত্তা অধ্যুষিত এলাকায় এই চা চাষে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
চা চাষের উদ্দ্যেশ্যে ২০১৭ সালে ১৩ জন স্থানীয় কৃষককে তিনি পঞ্চগড়ে চা–চাষ দেখতে পাঠিয়েছিলেন, এর পরের বছরের এপ্রিল মাসে তিন উপজেলার ২৬ জন কৃষক এ চাষ শুরু করেন তার কোম্পানির হয়ে এবং দেখা যায়, এখানে যেসব জমিতে চায়ের আবাদ করা হচ্ছে, এর মধ্যে ৯০ ভাগ আবাদই চমৎকার হয়েছে। চা–চাষের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে এখন আরও শতাধিক কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আমজাদ হোসেন দুই লাখ চারা দিয়ে একটি নার্সারি তৈরি করেছেন। আবার শেরপুর শহরে তৈরি করছেন চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা।
চা চাষ কে কেন্দ্র করে উপরোক্ত ঘটনাগুলোর মতো আরও অসংখ্য সাফল্যের গল্প তৈরী হচ্ছে এবং হবে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে।
ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষে প্রাপ্তি এবং ই-কমার্স উদ্যোক্তা তৈরীর সম্ভাবনাঃ
ক্ষুদ্র আকারে চা–চাষ জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ এখান থেকে দ্রুত এবং স্থায়ী আয় হয়। বাড়তি শ্রমিকের খুব বেশি প্রয়োজন হয় না, চাইলে শুধু পরিবারের সদস্যরা মিলেই চাষ করা যায়। ফলে খরচও অনেকাংশে কমে যায়। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীও চা চাষ করে জীবন জীবীকা নির্বাহ করতে পারবে, যা দেশের দারিদ্রতা দূরীকরণে সাহায্য করবে।
আর এই ক্ষুদ্র চা উদ্যোক্তা বা চাষীদের সর্বাত্মক সহায়তা করতে প্রস্তুত চা উন্নয়ন বোর্ড। টি বোর্ডের মতে, দেশে এখন চা এর উৎপাদনের তুলনায় অতিরিক্ত চাহিদা হওয়ায় বাড়তি চা আমদানী করতে হচ্ছে বাইরে থেকে। কিন্তু এই ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ আরও বৃদ্ধি পেলে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আর আমদানি নির্ভরতা থাকবে না বরং দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরে ব্যাপক পরিসরে রপ্তানীও করা যাবে।
এই সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের খাতকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ অঞ্চলে তৈরী হতে পারে ই-কমার্স উদ্যোক্তা। যেহেতু এই অঞ্চলের জন্য এটি নতুন একটি খাত এবং চা এর প্রচুর চাহিদা দেশে রয়েছে, তাই অত্র এলাকায় উৎপাদিত চা পাতা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে ই-কমার্স কেন্দ্রিক নতুন চা এর ব্র্যান্ড। আর স্বভাবতই ই-কমার্স এমন একটি মাধ্যম যার ব্যবহারে খুব দ্রুত অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। তাই খুব সহজে ময়মনসিংহে উৎপাদিত চা এর বিশেষত্ব সারাদেশে, এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব।
আর ময়মনসিংহে অনেক স্থানীয় ই-কমার্স উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা সিলেটের চা পাতা নিয়ে কাজ করছেন। দূর থেকে সোর্সিং করতে তাদের অনেক ধরণের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই উদ্যোক্তারা নিজ এলাকার চা এর কথা জানতে পারলে অবশ্যই অন্য জেলা থেকে প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়ে সোর্সিং করার প্রয়োজন পরবে না, বরং নিজ জেলার চা পাতাকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন। তাই ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্রায়তনে উৎপাদিত এসব উন্নতমানের চা পাতার আরও প্রচার করতে হবে বিভিন্ন নিউজ মিডিয়ার মাধ্যমে এবং সোসাল মিডিয়ায় পর্যাপ্ত কন্টেন্ট আর্টিকেল লেখার মাধ্যমে।
জানা যায়, চা উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহ অঞ্চলের চা চাষ কে ঘিরে যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, এই প্রকল্পের আওতায় ৮৯ লাখ চারা বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। চাষিদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হবে। এবং চাষের পর তিন বছর কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। এ ছাড়া পাঁচ জেলার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি চা প্রসেসিং কারখানা করা হবে। সরকারি খরচে পরিবহনের মাধ্যমে অন্যান্য জেলা থেকে কৃষকদের জমি থেকে চা পাতা কারখানায় আনা হবে। এতে বহুলোকের কর্মসংস্থান তৈরী হবে।
সুতরাং বলা যায়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সবমিলিয়ে এই অঞ্চলের চা শিল্পকে কেন্দ্র করে খুলে যাচ্ছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। একে কাজে লাগাতে পারলে সমৃদ্ধ হবে ময়মনসিংহ অঞ্চল তথা পুরো দেশের অর্থনীতি।