“সাদা সোনা” খ্যাত রাবার অত্যন্ত মূল্যবান অর্থকরী বনজ সম্পদ, যা দেশের কৃষি ও শিল্পখাতে সৃষ্টি করতে পারে দারুণ সব সম্ভাবনা। সত্যিকার অর্থে যে কোনো শিল্পের সমৃদ্ধি তখন হয়, যখন সেটার প্রচার বৃদ্ধি পায়, মানুষ সেই শিল্প সম্পর্কে ভালোভাবে জানার সুযোগ পায় এবং সেটা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়। সেদিক বিবেচনায় দেশের রাবার শিল্প অনেকখানি পিছিয়ে আছে, কারণ রাবারের আদিপান্ত্য সম্পর্কে এখনো দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠীর জ্ঞান খুব স্বল্পই বলা যায়। মানুষের কাছে এই শিল্পের সম্ভাবনাকে পৌঁছে দেয়ার এই গ্যাপটাই পূরণ করতে পারে ই-কমার্স।
রাবার কি, কোথায়, কিভাবে এটা উৎপন্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে রাবার গাছের আগমন ইতিহাস, দেশের অর্থনীতিতে এই শিল্পের সম্ভাবনা আর চ্যালেঞ্জগুলো সহ ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিখ্যাত রাবার বাগান সম্পর্কে জানানোর মাধ্যমে রাবার শিল্প নিয়ে সবার মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করা হল এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
রাবার কি?
রাবার গাছ থেকে উৎপন্ন তরল কষ বা ল্যাটেক্স জাতীয় পদার্থের ঘনীভূত শক্ত কঠিন রূপই হল রাবার। গাছ থেকে উৎপন্ন এই লেটেক্সের মধ্যে শতকরা প্রায় ২৫-৩০ ভাগ রাবার হাইড্রোকার্বন, ৬০ ভাগ পানি, বাকি অংশে প্রোটিন, পেগমেন্ট, লবণ ও চিনি জাতীয় পদার্থ। একে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন ধরণের ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরী করা হয়ে থাকে। রাবার গাছ প্রায় ২০-২৫ ফুট লম্বা হয়। রাবার গাছ পরিপক্ক হতে ৬-৭ বছর সময় লাগে এবং ৮ম বছর থেকে রাবার কষ সংগ্রহ করা যায়। একটি রাবার গাছ সাধারণত ৩২-৩৪ বছর বয়সে তার উৎপাদন আয়ু শেষ করে। আয়ু অতিক্রান্ত গাছগুলো কেটে পুনরায় বাগান তৈরি করা হয়। এ সকল গাছ থেকে গড়ে ৫-৮ ঘনফুট গোল কাঠ পাওয়া যায়।
রাবার গাছ শুধু রাবার উৎপন্ন করে তাই নয়, এই গাছগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়, পরিবেশের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ গাছ অন্য যেকোনো গাছের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন এবং কার্বন শোষণ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর রাবার বাগান (যেখানে প্রায় ৪১৫টি উৎপাদনশীল রাবার গাছ রয়েছে) বায়ুমন্ডল থেকে বার্ষিক ৩৯.০২ টন কার্বন শোষণ করে, যা উষ্ণতা রোধে ও পরিবেশ রক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং রাবার গাছ যেমন আমাদের অর্থনীতি বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে, ঠিক তেমনি পরিবেশ রক্ষায় এটি সমান অবদান রেখে যাচ্ছে।
রাবার গাছের আবির্ভাব
যতদূর জানা যায়, রাবার গাছের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান উপত্যকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং দক্ষিন আমেরিকার প্রথম রাবার আবিষ্কারক হিসেবে ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে গণ্য করা হয়, যিনি কিনা ১৪৯৬ সালে সেখান থেকে কিছু রাবার বল নিয়ে আসেন, যা এক ধরনের গাছের আঠা হতে তৈরী। হাইতির লোকেরা খেলার জন্য সেই রাবার বল ব্যবহার করতো তখন। এরপর ১৮৭৩-১৮৭৬ সালের দিকে ব্রাজিল থেকে লন্ডনের কিউ গার্ডেনে রোপণের জন্য কিছু রাবার চারা নিয়ে আসে ব্রিটিশদের এক উৎসাহী দল। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যায় এই রাবার চাষ, যা থেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কষ আহরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে প্রথম সিঙ্গাপুর।
বাংলাদেশে প্রথম রাবার চাষের গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রিটিশদের হাত ধরেই বিংশ শতাব্দীতে। ১৯১০ সালে কলিকাতা বোটানিক্যাল হতে কিছু চারা এনে চট্রগ্রামের বারমাসিয় ও সিলেটের আমু চা বাগানে রোপন করা হয়েছিল। এরপর ১৯৫২ সালে বনবিভাগ টাংগাইলের মধুপুর, চট্রগ্রামের হাজেরীখিল ও পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় পরীক্ষামূলক কিছু গাছ রোপন করে এবং ১৯৫৯ সনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মিঃ লয়েড এদেশের জলবায়ু ও মাটি রাবার চাষের উপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে রাবার চাষের সুপারিশ করেন। সেই থেকে বন বিভাগ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বানিজ্যিক ভাবে রাবার চাষ করে, রাবার বাগান তৈরী করে দেশের কৃষি এবং শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে কাজ করে চলেছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাবার চাষ হচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রামু, রাউজান, ডাবুয়া, হলুদিয়া, কাঞ্চননগর, তারাখো, দাঁতমারা, সিলেটের ভাটেরা, সাতগাঁও, রূপাইছড়া, শাহাজী বাজার, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, টাঙ্গাইলের মধুপুর, শেরপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এলাকাসহ লামার বিস্তীর্ণ এলাকা। সারাদেশে ১৩০৪ টি বেসরকারি রাবার বাগান রয়েছে এবং ৩২,৬২৫ একর জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ২৪,০০০ মেট্রিক টন রাবার উত্পন্ন হচ্ছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ছয়’শ কোটি টাকা।
রাবার উৎপাদন পদ্ধতি
সারা বছরই রাবার উৎপাদন চলে। তবে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ মাস রাবার উৎপাদনের ভর মৌসুম। শীতে কষ আহরণ বেশি হয় আর বর্ষায় উৎপাদন কমে আসে। একটি পরিপক্ব রাবার গাছ থেকে বেশি কষ সংগ্রহ করতে হলে টেপিং কাজটা সূর্য ওঠার আগে অর্থাৎ খুব ভোরে করতে হয়। কারণ এ সময় সূর্যের আলো পর্যাপ্ত না থাকায় গাছে প্রস্বেদন ক্রিয়া শুরু না হওয়ায় কষনালীতে কষপ্রবাহ চালু থাকে, আর সূর্যের তাপ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কষনালীসমূহ সঙ্কুচিত হয়ে যায় ফলে কষপ্রবাহে তার স্বাভাবিক গতির ব্যাঘাত ঘটে।
বাগান থেকে সাদা কষ সংগ্রহের পর ৭ দিনের মধ্যে তা প্রক্রিয়াজাত করে শুকনো রাবারে পরিণত করা যায়। বাগান থেকে কষ সংগ্রহ করে কারখানায় আনার পরে কষগুলো নিদির্ষ্ট পাত্রে ঢালা হয়। এরপর কষের সঙ্গে পানি ও অ্যাসিড মিশিয়ে নির্ধারিত স্টিলের ট্যাং-এ জমা রাখা হয়। সেখানে আলাদা প্লেট বসিয়ে কোয়াগোলাম বা রাবার সিটে পরিণত করা হয়। এরপর রোলার মেশিনের সাহায্যে কষ থেকে পানি বের করে ড্রিপিং শেডে শুকানো হয়। পরে ধুমঘরে তা পোড়ানো হয়। ওই প্রক্রিয়া শেষে রাবার ৫০ কেজি ওজনের বান্ডিল করে বস্তাভর্তি করে গুদামজাত করা হয় এবং চাহিদা মতো সারাদেশে এবং দেশের বাইরেও রপ্তানী করা হয়।
সন্তোষপুর রাবার বাগান, ময়মনসিংহ
বিএফআইডিসি (বাংলদেশ বন উন্নয়ন কর্পোরেশন) এর উদ্যোগে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ১০৩৬ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে “সন্তোষপুর রাবার বাগান”। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল বিশাল এই রাবার বাগান তৈরীর কাজ, আর ১৯৯৭ সাল থেকে এই বাগান থেকে রাবার উৎপাদন কাজ শুরু হয়েছিল। এখানে বর্তমানে ১৯১ টি ব্লকে ৩০০ করে রাবার গাছ রয়েছে, কষ আহরণের জন্য ট্রেপার রয়েছে ২০১জন। সন্তোষপুর রাবার বাগানের ব্যবস্থাপকের থেকে ২০২০ সালে পাওয়া তথ্য মতে, সেই বছরে এই বাগান থেকে রাবার উৎপাদন টার্গেট ছিল ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন, প্রতিদিনের রাবার প্রোডাকশন টার্গেট ১৬৯৩ কেজি, এই টার্গেট তারা ভালোভাবেই ফুলফিল করতে পারেন যদি বৃষ্টি বাদল কম হয়। কারণ বর্ষাকালে অধিক বৃষ্টিপাতের সময়টায় ট্যাপিং (রাবার কষ সংগ্রহ) করা যায় না।
রাবার শিল্পে চ্যালেঞ্জসমূহ
২০১০-১১ সন হতে রাবার বিক্রির উপর ১৫% ভাট এবং টেন্ডারে বিক্রির ক্ষেত্রে আয়কর ও সেবা খাতে আরও ৯%সহ মোট ২৪% কর আরোপ করায় এবং বিদেশ থেকে রাবার আমদানীর ক্ষেত্রে আমদানী শুল্ক ১৫% থেক ৫% এ কমিয়ে আনার ফলে দেশে উৎপাদিত রাবার বিক্রি হ্রাস পেয়েছে।
বিএফআইডিসির অধিকাংশ কারখানা ও এর যন্ত্রপাতি অনেক পুরাতন হওয়ায়, দুর্বল ও অপ্রতুল অবকাঠামো এবং দক্ষ জনবলের অভাব থাকায় রাবারের গুনগত মানের সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের রাবার ক্লোনের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে উন্নতমানের রাবার বাগান সৃজন সম্ভব হচ্ছে না। (সূত্রঃ বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন)
দেশে উৎপাদিত রাবার দিয়ে দেশের চাহিদার ৬০ ভাগ মেটানো সম্ভব হলেও প্রয়োজনের তুলনায় বিদেশ থেকে বেশি রাবার আমদানি করায় সম্ভাবনাময় এই “সাদা সোনা” খ্যাত অর্থকরী পণ্য তার গৌরব হারাচ্ছে, হুমকির মুখে পড়েছে দেশের এই রাবার শিল্প। দেশের নীতিনির্ধারকদের সুদৃষ্টিই পারে দেশের এই ক্রমবর্ধমান শিল্পকে পরিপূর্ণতা দিতে।
রাবার শিল্পের সম্ভাবনা
রাবার কৃষি এবং শিল্প উভয় খাতের উন্নয়নেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অনুর্বর জমিতে রাবার চাষ ভালো হওয়ায় দেশের যে সব অঞ্চলের জমিতে অন্যান্য ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না, সেই সব জমিকে রাবার চাষের মাধ্যমে কাজে লাগানো যেতে পারে।
সারাবিশ্বে বর্তমানে রাবার দিয়ে ১ লক্ষ ২০ হাজার ধরনের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে আর রাবার কাঠ দিয়ে তৈরী হচ্ছে উন্নতমানের সৌখিন সব আসবাবপত্র।
রাবার শিল্পের কার্যক্রমকে কৃষি এবং শিল্প এই দুই ইউনিটেই বিভক্ত করেছে বন বিভাগ। কৃষি সেক্টরের অধীনে রাবার চাষ, আহরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাত করা হয়। রাবার উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ বেশ পরিশ্রমের হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত পাহাড়ী বা সমতল অঞ্চলে অবস্থিত বাগানগুলোতে অশিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত নারী পুরুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও গ্রামীন জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারছে।
আবার রাবার গাছগুলো অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারানোর পর সব গাছ কেটে প্রাপ্ত কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণের পর শক্ত ও টেকসই ১ম শ্রেণীর কাঠ হতে উন্নতমানের আসবাবপত্র এবং কাঠজাত সামগ্রী তৈরী করা হয়। মালয়েশিয়া রাবার কাঠ হতে পার্টিকেল বোর্ড,লেমিনেটিং বোর্ড, মিডিয়াম ডেনসিটি ফাইবার বোর্ড ইত্যাদি তৈরী করে বিশ্ববাজারে রাবার কাঠের ব্যাপক চাহিদা তৈরী করেছে। অপরদিকে শ্রমিক সংকট এবং শ্রম দর বৃদ্ধি পাওয়ায় এশিয়ার সর্বাধিক রাবার সরবরাহকারী দেশ মালয়েশিয়া পর্যায়ক্রমে রাবার চাষ কমিয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশাল সুযোগ তৈরী করেছে, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে সরকার এবং রাবার শিল্প নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশে রাবারের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই দেশের চাহিদা মিটাতে এবং রাবার আমদানী কমিয়ে বরং রাবার ও রাবার কাঠ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে কাজ করতে হবে আমাদের দেশকে।
ময়মনসিংহে বিশাল রাবার বাগান থাকলেও, রাবার পণ্য উৎপাদনকারী তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান এখানে এখনো গড়ে না উঠায়, রাবার শিল্পকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহে গড়ে উঠতে পারে বিভিন্ন ই-কমার্স উদ্যোগ, যেমন- প্রশিক্ষিত রাবার শ্রমিক সরবরাহ কোম্পানি, রাবার থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন কারখানা, রাবার কাঠ প্রক্রিয়াজাত কারখানা, রাবার কাঠের আসবাব তৈরীর কারখানা ইত্যাদি। ই-কমার্সের মাধ্যমে এই শিল্পের সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির কথা সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া যাবে, যা এই শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সাহায্য করবে।