বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা ফেনী। প্রশাসনিকভাবে এটি একই সাথে ফেনী জেলা এবং ফেনী সদর উপজেলার সদর। ২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট এবং শান্ত জেলাটির জনসংখ্যা ১৫৬,৯৭১ জন। ফলে ফেনী জেলা এখন বাংলাদেশের ২৭তম বৃহত্তর শহর। উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের কারণে ফেনী দেশের বিখ্যাত একটি জেলা।দ্রুত বর্ধনশীল নগরাঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম ফেনী জেলা। এই জেলার ইতিহাস সংস্কৃতি ও সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের কৃষ্টিতে পরিপূর্ণ।দশ হাজার বছর আগে এ জায়গায় লোকবসতি ছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে যে মহকুমা গুলোকে জেলায় রূপান্তর করা হয়েছিল ফেনী জেলা তার একটি। ১৯৮৪ সালের আগে এটি নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা ছিল।এ মহকুমার গোড়াপত্তন হয় ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মীরসরাই, ছাগলনাইয়া ও আমীরগাঁও এর সমন্বয়ে। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। ১৮৭৬ সালে মীরসরাইকে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথম মহকুমা সদর দপ্তর ছিল আমীরগাঁওয়ে। ১৮৭২ থেকে ১৮৭৪ সালের মধ্যে মোগল আমলের আমীরগাঁও থানা নদী ভাঙ্গনের ফলে ফেনী নদীর ঘাটের কাছাকাছি খাইয়ারাতে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তীতে এটি ফেনী থানা নামে পরিচিতি পায়। এরপর ১৮৭৬ সালে নতুন মহকুমার পত্তন হলে খাইয়ারা থেকে থানা দপ্তরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তরিত হয় ও নতুন মহকুমাটি ফেনী নামে পরিচিত হয়।পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে তা ফেনী শহরে স্থানান্তরিত হয়।
ফেনী জেলার নাম নিয়ে প্রচুর জনশ্রুতি রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন মতবাদ।ফেনী নদীর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফেনী। মধ্যযুগে কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় একটি বিশেষ নদীর স্রোতধারা ও ফেরী পারাপারের ঘাট হিসেবে ফনী শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীর সময়ে কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলপুরের বর্ণনায় উল্লেখ করেন,
“ফনী নদীতে বেষ্টিত চারিধার,
পূর্বে মহাগিরি পার নাই তার”
এরপর সতের শতকে মির্জা নাথানের ফার্সী ভাষায় রচিত বাহরিস্তান-ই-গায়েবীতে ফনী শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ফেনী-তে পরিণত হয়।আঠারো শতকের শেষার্ধে কবি আলী রজা তার পীরের বসতি হাজীগাঁও এর অবস্থান সম্পর্কে লিখছেন,
“ফেনীর দক্ষিণে এক ষর উপাম,
হাজীগাঁও করিছিল সেই দেশের নাম”
এভাবে তারা নদী অর্থে ফেনী ব্যবহার করেছেন। ধারণা করা হয় আদি শব্দ ফনী মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় ফেনীতে পরিণত হয়েছে।
অতীতে এ অঞ্চল ছিল সাগরের অংশ, তবে উত্তর পূর্ব দিক ছিল পাহাড়িয়া অঞ্চল। ফেনীর পূর্ব দিকের রঘুনন্দন পাহাড় থেকে কাজিরবাগের পোড়ামাটি অঞ্চলে হয়ত আদিকালে শিকারী মানুষের প্রথম পায়ের চিহ্ন পড়েছিল। এখানকার ছাগলনাইয়া গ্রামে ১৯৬৩ সালে একটা পুকুর খনন করার সময় নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত একটি হাতিয়ার পাওয়া গেছে। পণ্ডিতদের মতে এটি অন্তত দশ হাজার বছরের পুরনো।
যেহেতু ফেনী জেলা সাগর এলাকা ছিলো তাই কচুরিপানা যুক্ত জলাভূমি বেশি ছিলো। কারো কারো মতে এই জেলার নামকরণ হয়েছে সে কচুরিপানার জন্য সৃষ্টি হওয়া ফেনার থেকে। আরেকটি প্রচলিত জনশ্রুতি রয়েছে তা হলো ফেনীর অদূরে একটি পোড়ামাটির পাহাড় ছিলো যার নাম শিলার শহর নামে পরিচিত ছিলো। আর এটি ছিলো ফনী নামক সামন্ত রাজার রাজধানী। তাই নাকি তার নামানুসারে ফেনী জেলার নাম রাখা হয়েছিল৷ আরো একটি মতবাদ রয়েছে, বহু বছর আগে চীনা পর্যটক এসেছিলেন সফরে, তখন তিনি ফেনীতে অবস্থান করেছিলেন আর তার নাম ছিলো ফা-হিয়েন। তার নাম অনুযায়ী ফেনী নাম রাখা হয়। মজার একটি মতবাদ রয়েছে তা হলো জেলার আয়তন অনুযায়ী এখানে খাল বিল নদী বেশি হওয়াতে এতে সাপ এর উৎপাত ছিলো অনেক বেশি। এ থেকে বাঁচতে কাঁটাযুক্ত গাছ ফণীমনসার চাষ করা হতো এ অঞ্চলে, সেই থেকে ফেনী নামের উৎপত্তি হয়েছে এমনটা শোনা যায়। আরো অনেকের মতে ফেনীর আদিনাম ছিলো শমসেরনগর।
ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের ইতিকথায় বলেছেন, প্রাচীনকালে আধুনিক ফেনী অঞ্চল ছাড়া নোয়াখালীর বেশির ভাগ ছিল নিম্ন জলাভূমি। তখন ছিল এটি অনেকটা দ্বীপের মতো। ছাগলনাইয়া নামকরণ এর ব্যাপারটি নিয়ে একটি গল্প আছে। জায়গাটির নাম ছিলো আসলে সাগর নাইয়া। ইংরেজ আমলের শুরুতে সাগর শব্দটি ভুল ক্রমে সাগল নামে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তাই ছাগল নাইয়া শব্দটি প্রচলিত হয়ে ওঠে।ইংরেজ আমলের আগের কোন পুঁথি-পত্রে ছাগল নাইয়া নামের কোন স্থানের নাম পাওয়া যায় নি।ফেনী নদীর তীরে রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বীর বাঙ্গালী শমসের গাজীর রাজধানী ছিল। তিনি এখান থেকে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে রৌশনাবাদ ও ত্রিপুরা রাজ্য জয় করেন। তিনিই চম্পক নগরের একাংশের নামকরণ করেছিলেন জগন্নাথ সোনাপুর।১৫২৫ সালে পাঠান সুলতান নুসরত শাহ চট্টগ্রাম জয় করার পর সেনাপতি ছুটি খাঁ-কে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কবিনর শ্রীকরনন্দী মহাভারতের অনুবাদ প্রচার করেছিলেন এবং তাতে সেনাপতির আবাসস্থল নিয়ে বর্ণনায় ফেনী নদীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি মতবাদ এসেছে নদী নিয়ে তাই ধারণা করা হয় ফেনী জেলার নাম ফেনী নদীর নামানুসারেই হয়েছে।