মুন্সীগঞ্জ জেলার চারপাশকে ঘিরে রয়েছে তিনটি নদী এবং মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থান করছে একটি নদী। নামঃ পদ্মা,মেঘনা,ইছামতি,ধলেশ্বরী। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এই নদীগুলো তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে।তবে নদীর গতিপথ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মাথায় আসবে ১৫৫০ সালে প্রণীত “জাও দ্য ব্যারোস”, ১৬৬০ সালে প্রণীত “ফন ডেন ব্রোক”, ১৭৬৪-৭৬ সালে প্রণীত “রেনেলে” এর মানচিত্র।প্রাচীনকালের নদী ব্যবস্থা জানার জন্য এর চেয়ে নির্ভুল কোনো মানচিত্র খুব একটা নেই।
পদ্মা নদীঃ
পদ্মা বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী।পদ্মার অপর নাম কীর্তিনাশা।মুন্সিগঞ্জ জেলার দক্ষিণসীমায় পদ্মার অবস্থা। তবে প্রাচীন কালে পদ্মা বিশাল বিক্রমপুরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছিলো।ভারতের গঙ্গার যে শাখাটি রাজশাহী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেটিই পদ্মা নামে অভিহিত। রাজশাহী থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পদ্মা প্রবাহিত হয়ে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে এসে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সেখান থেকে আবার পূর্ব দিকে প্রাচীন বিক্রমপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।বর্তমানে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ থেকে পদ্মার পাশে ঘেরা বিভিন্ন জেলা গুলোতে যাবার জন্য ব্যবহৃত হয় মাওয়া ঘাট ,যা মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায় অবস্থিত। এ এলাকা দিয়েই প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে।
তবে মেজর রেনেলের অঙ্কিত ১৭৮১ সালের মানচিত্রে দেখা যায়, পূর্বের পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছিলো বিক্রমপুরে পশ্চিম দিক দিয়ে। বিক্রমপুরের রাজনগর ও ভাদ্রেশ গ্রামের মধ্যে একটি অপ্রশস্ত জলপ্রণালি ছিলো।তবে ১৮১৮ সালে এ পদ্মার প্রধান স্রোত রেনেলের কালীগঙ্গার খাতে প্রবাহিত হতো। এ পরিবর্তন ক্রমে ক্রমে ঘটেছিল। এমনকি ১৮৪০ সাল পর্যন্ত পদ্মা দক্ষিণ বিক্রমপুরের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হতো। এ নদী তখনো পদ্মা নামে এবং নতুন নদীটি কীর্তিনাশা নামে পরিচিত ছিল।
১৭৬৪ সালে মেজর রেনেল ঢাকার উত্তর অংশেই ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সম্মিলন দর্শন করেছিলেন। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, ১৬ শতকে এটিই ব্রহ্মপুত্রের মূল স্রোত ছিল। এ স্রোত ঢাকার পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জাফরগঞ্জের কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। এ সম্মিলিত প্রবাহ রেনেলের উল্লিখিত নালা ও ফরিদপুরের অন্তর্গত পাঁচ্চরের মধ্যস্থিত পদ্মার প্রাচীন খাত পরিত্যাগ করে ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজবাড়ী মঠের কিঞ্চিত্ দক্ষিণে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। ১৭৮৭ সালের বন্যার ফলেই যে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার প্রাচীন প্রবাহের পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই সব থেকে বুঝা যায়,পদ্মার গতি পরিবর্তন আসলেই অতি বিচিত্র।
ধলেশ্বরী নদীঃ
বিক্রমপুরের উত্তরসীমায় ধলেশ্বরী নদী অবস্থিত। এ নদীটি যমুনার একটি শাখা নদী হিসেবে বিবেচিত। টাঙ্গাইল জেলার উত্তর পশ্চিম প্রান্তে যমুনা নদীর থেকেই ধলেশ্বরীর সূচনা। এটি এর পর দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় – উত্তরের অংশটি ধলেশ্বরী আর দক্ষিণের অংশটি কালীগঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়। এই দুইটি শাখা নদী মানিকগঞ্জ জেলার কাছে মিলিত হয়, এবং সম্মিলিত এই ধারাটি মুন্সীগঞ্জ জেলার উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ধলেশ্বরী নামে নারায়নগঞ্জ জেলার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে মিলিত হয়ে পরবর্তীকালে মেঘনা নদীতে পতিত হয়। ধলেশ্বরী বর্তমানে যমুনার শাখা হলেও প্রাচীন কালে এটি সম্ভবত পদ্মা নদীর মূল ধারা ছিলো। ১৬০০ হতে ২০০০ সালের মধ্যে পদ্মার গতিপথ ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। ধারণা করা হয়, কোনো সময়ে পদ্মার মূল ধারাটি রামপুর-বোয়ালিয়া এলাকা ও চলন বিল এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে, পরে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর মাধ্যমে মেঘনায় গিয়ে পড়তো। ১৮শ শতকে পদ্মার নিম্ন প্রবাহটি ছিলো আরো দক্ষিণে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মূল প্রবাহ ধলেশ্বরী হতে দক্ষিণের প্রবাহে, তথা কীর্তিনাশা নদীতে সরে যায়, যা বর্তমানে পদ্মার মূল গতিপথ।বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার দিকে প্রবাহিত ধলেশ্বরী নদীর উপরেই অবস্থান করছে ৬ষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, যার নাম হচ্ছে,মুক্তারপুর সেতু।
মেঘনা নদীঃ
মেঘনা নদীর আরেক নাম মেঘনা আপার নদী।এই নদী বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর একটি।এই নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর এবং লক্ষ্মীপুর জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৫৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৪০০ মিটার। মেঘনা একটি সর্পিলাকার প্রকৃতির নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক মেঘনা আপার নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ১৭।
মুন্সিগঞ্জ জেলার পূর্ব দিকেও মেঘনা নদীর একটি অংশ অবস্থান করছে।যা মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা এবং গজারিয়া উপজেলাকে বিভক্ত করেছে।মেঘনা নদীর ধার ঘেষেই গড়ে উঠেছে গজারিয়া উপজেলা।মূলত নদীটি কিশোরগঞ্জ জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব বাজারের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং ভৈরব বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে কলাগাছিয়ায় শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী একত্র হয়ে বিক্রমপুরের পূর্ব পাশ দিয়ে চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ইছামতি নদীঃ
ইছামতী নদীর আরেক নাম হচ্ছে, ইচ্ছামতি বা ইছামতি-কালিন্দি নদী।এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী।এই নদীটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক এই নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর হচ্ছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী হিসেবে ৭ নং এবং উত্তর কেন্দ্রীয় নদী হিসেবে ৪ নং।
সর্পিলাকার আকৃতির এই নদীর একটি বাঁক মুন্সিগঞ্জ জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি মূলত বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।উত্তর কেন্দ্রীয় এই নদীটির দৈর্ঘ্য ১২৯ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭২ মিটার।
এই নদীটি উৎপত্তি লাভ করেছে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে প্রবহমান যমুনা নদী হতে।এবং এর জলধারা ঢাকা জেলার, নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলার, লৌহজং উপজেলার ,লোহাজং টেওটিয়া ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীতে নিপতিত হয়েছে। বারোমাসি প্রকৃতির এই নদীতে সারাবছর জলপ্রবাহ থাকে। তবে বর্ষাকালে নদীটিতে স্বাভাবিকের চেয়ে জলের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়।তবে দুঃখজনক হচ্ছে পলি মাটির প্রভাবে নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, এর প্রশস্ততা সংকুচিত হচ্ছে এবং পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে।