ছোটবেলা থেকেই আমরা সবুজ ধানক্ষেত দেখে অভ্যস্ত। মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজ ধানক্ষেত গুলো বিস্তৃত।যদি হঠাৎ দেখতে পান এই সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে বেগুনি একখন্ড ধানক্ষেত। কি খুব বেশি অবাক হবেন তাইনা। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ ধানক্ষেত আবার বেগুনি হয় নাকি। বাপের জন্মে তো দেখিনি বাপু। তবে এটাই সত্যি। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় বেগুনি ধান আবাদ করা হচ্ছে।
বেগুনি রঙের এই ধানকে বলা হয় পার্পল রাইস।শুধু কি পার্পল রাইস? না একে কালো চাল, নিষিদ্ধ ধান এমনকি সম্রাটের চালও বলা হয়। কেনো হলো এই নামগুলো চলুন জেনে নেওয়া যাক। কথিত আছে চীনের রাজপরিবারের মধ্যে বেগুনি চালের ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিলো।চীন দেশের রাজারা গোপনে এই ধান চাষ করতো।তখনকার বিভিন্ন রাজা, বাদশা,প্রভাবশালীরা ছাড়া আর কেউ এই চাল খেতে পারতো না।বেগুনি চাল স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ভালো,পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং বেগুনি চালের ভাত খেলে দীর্ঘজীবী হওয়া যায় এমন কথা প্রচলিত ছিলো বলে রাজপরিবারের বাহিরে এর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। যদি এই নিষেধাজ্ঞা কেউ অমান্য করতো তবে তাকে শাস্তিস্বরুপ মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। পারিবারিক উৎসব কিনবা যুদ্ধ জয়ের উৎসবে সম্রাট যোদ্ধাদের সম্মানে একত্রে বসে এই বেগুনি চালের ভাত খেতো। ফলে বেগুনি ধানকে নিষিদ্ধ ধান এবং সম্রাটের ধানও বলা হতো।
এশিয়ার বিভিন্ন বনে জঙ্গলে পার্পল রাইসের উপস্থিতির ফলে এর আদিনিবাস সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি।এর পুষ্টিগুণের কথা জেনে বর্তমানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক ভাবে পার্পল রাইস আবাদ করা হচ্ছে।বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জাত হিসেবে চাইনিজ জাত, ভিয়েতনামী জাত, জাপানী জাত, ইন্ডিয়ান জাত, বাংলাদেশী জাত উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পার্পল রাইসের নামের যেমন ভিন্নতা আছে তেমনি বাংলাদেশেও এর নামে বৈচিত্রতা দেখা যায়। কেউ বলে গোলাপী ধান, কেউ বলে বেগুনি ধান আবার কেউবা বলে ব্ল্যাক রাইস। বাংলাদেশে প্রথম গাইবান্ধায় এই ধান চাষ হয়।
পার্পল রাইস এশিয়াতে উৎপন্ন একটি প্রাচীন উওরাধিকারী ধান। এটি উফশী জাতের ধান যার পাতা,ধান এবং চালের রঙ এমনকি ভাতও বেগুনি রঙের। এটি কোনো বিদেশী জাত নয় বরং আমাদের দেশীয় ধানের জার্মপ্লাজম।ধানের গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে বেগুনি রঙ গাঢ় হতে থাকে। শস্যগুলো অবশ্য কাঁচা অবস্থায় কালি কালো রং ধারণ করে বলে একে কালো চালও( ব্ল্যাক রাইস)বলে। এই জাতের ধানের আয়ুষ্কাল কম সাধারণত ১৪৫-১৫৫ দিন হওয়ায় আগাম ফল পাওয়া যায়। এছাড়া দ্রুত ফলন দেওয়ায় ধানে রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ কম।বাজার দাম বেশি এবং কম খরচে চাষ করা যায় ফলে চাষীরা দিনদিন নতুন জাতের এই ধান চাষে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছে।
টাংগাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলাও পার্পল রাইস চাষ করছে। উপজেলাটির বারোপাখিরা গ্রামের কয়েকজন কৃষক গতবছর থেকে পার্পল রাইস চাষ করছেন। কৃষকরা জানান তারা প্রথম টিভিতে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানে এই বেগুনি ধান দেখতে পান এবং এ জাত চাষে আগ্রহী হন। কৃষকেরা স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সহায়তায় বেগুনি জাতের বীজ সংগ্রহ করেন। তারপর সেই বীজ থেকে ধান চাষ করে বেশ লাভবান হন। বুরো সিজনে ফালো ফলন হয়। কৃষকদের কাছ থেকে জানা গেছে গাছ প্রতি ১৮-২৮ টি শীষ থাকে এবং পাশাপাশি ১ টি শীষে ১৬০-৩১৩ টি ধাপ থাকে। হেক্টর প্রতি ৪-৫ টন ধান পাওয়া যায়।বেগুনি জাতের ধান গাছ শক্ত হওয়ায় ঝড় বৃষ্টিতে হেলে পড়ে না। যার জন্য প্রতিকূল পরিবেশে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে।মোটকথা কম পরিচর্যায় বাম্বার ফলনের দেখা মেলে। আর এ কারণেই বেগুনি ধান চাষে ব্যাপক সাড়া পড়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। আশেপাশে থেকে প্রায় প্রতিদিন উৎসুক মানুষ এই বেগুনি ধানক্ষেত দেখতে আসে। স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাজিবুল হাসান মল্লিক বেগুনি জাতের ধান খুব তাড়াতাড়ি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করবেন বলে আশ্বাস দেন।শুধু দেলদুয়ার না বাজিতপুরও কিছু কিছু জায়গায় পার্পল রাইস চাষ করা হয়।জায়গাটি টাংগাইল সদরের কাছাকাছি। এখানকার কয়েকজন কৃষক বেগুনি ধান চাষ করা শুরু করেছেন।
পার্পল রাইস দেখতে যেমন সুন্দর খেতেও তেমনি সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।
◑ এটি প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার,এন্টিঅক্সিডেন্ট, আয়রন সমৃদ্ধ।
◑বেগুনি ভাত প্রোটিনের একটি ভালো উৎস। উপস্থিত প্রোটিন পেশিটিস্যু গঠন, কোষের বৃদ্ধিতে সহায়তা এবং হাড়কে শক্তিশালী করে।
◑এতে বিদ্যমান ভিটামিন ই যা একটি এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এন্টিঅক্সিডেন্ট ডায়বেটিস, স্থূলতা এবং হৃদরোগের উপশম ঘটায়।
◑বেগুনি ভাতে উপস্থিত ফাইবার ওজন হ্রাস,কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
◑প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে যা হৃদরোগ সৃষ্টির ঝুঁকি রোধ করে।
◑উপস্থিত আয়রন যা দেহের অক্সিজেন পরিবহন, লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।বেগুনি ভাতে দেহের জন্য পর্যাপ্ত আয়রন থাকে ফলে রক্তস্বল্পতা জনিত সমস্যা দেখা যায় না।
◑এছাড়াও বার্ধক্য, ক্যান্সার,ডায়াবেটিস সহ নানা রোগের ঝুঁকি কমাতে বেগুনি চালের ভাত বেশ কার্যকরী।
ধরুন কেউ যদি আপনাকে বেগুনি পায়েস সামনে খেতে দেয় তখন কেমন লাগবে। নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। কেননা বেগুনি পায়েস দেখতে যথেষ্ট ভালো লাগার মতোই ব্যাপার হবে। একদিকে সুন্দর রং, অপরদিকে সুস্বাদু পায়েস। যাতে কোনো রকম কেমিক্যাল রং এর ভেজাল নেই। আমাদের দেশে এখন বড় বড় রেস্তোরা, হোটেলে বেগুনি চালের ভাত পাওয়া যায়। যেহেতু অল্প পরিমাণে বেগুনি চালের চাষ এজন্য এর প্রচার ও চাহিদা এখনও তেমন বাজার দখল করতে পারেনি।
দামে সাদা চালের থেকে বেশি হওয়ায় অনেকেরই ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। তবে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ মাধ্যমে বেগুনি জাতের ধান উৎপাদন হার বাড়ানো সম্ভব। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বও নিতে হবে। আর ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে তা করা সম্ভব। যত বেশি প্রচারণা তত বেশি সম্ভাবনা।তাই ই-কমার্সে টাংগাইলের এই পার্পল রাইস হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় পণ্য।