চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী এবং দেশের ২য় বৃহত্তম শহর। এখানে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর “চট্টগ্রাম বন্দর” দেশের আমদানি ও রপ্তানির বৃহৎ অংশই হয়ে থাকে এই বন্দর দিয়ে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে ভারী শিল্প কারখানার পাশাপাশি গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠে, যা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখে আসছে।
সে ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই শহরে গড়ে উঠে “তাঁত শিল্প” যদিও বাংলাদেশে তাঁত শিল্পের ইতিহাস অনেক আগে থেকে কিন্তু এই ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম অনেকটা পিছিয়ে বলা যায়। কারণ সকল সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই শিল্পের প্রসার তেমনটা হয়ে উঠেনি।
চট্টগ্রাম এর পার্শ্ববর্তী তিন পাবর্ত্য জেলায় তাঁত শিল্পের ব্যাপক প্রসার হলেও চট্টগ্রাম এ তাঁতপল্লী তেমনিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি, সেজন্য একসময়কার ৮-১০ টি তাঁতপল্লী থেকে বর্তমানে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় ০১ টি মাত্র তাঁত পল্লী রয়েছে। যা নগরীর পাঁচলাইশ থানার ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ডের পুরাতন ওয়াপদা নামক জায়গায় অবস্থিত ।
সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় খুব জনাকীর্ণ এলাকায় হলেও এটির অবস্থান নগরীর বেশির ভাগ লোকের কাছে অজানা এবং এটিই চট্টগ্রামের একমাত্র “তাঁতপল্লী” যা আজও জীর্ণশীর্ণ ও কাঠামোগত ভঙ্গুর অবস্থায় টিকে আছে।
এই তাঁতপল্লীটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠা সমসাময়িক তাঁতপল্লীর একমাত্র “তাঁতপল্লী” এই সময়ে আবদুল মান্নান নামের একজন তাঁতীর সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি দীর্ঘ ৩০ বৎসর এই তাঁতের কাজ করে আসছেন, এক সময় রমরমা অবস্থা থাকলেও বর্তমানে আগের মত সেই জৌলুস নেই।
উনার সাথে আরো কথা বলে জানা যায়, এই তাঁত পল্লীর আশেপাশে আরো কয়েকটি তাঁতপল্লী ছিলো, তারমধ্যে অন্যতম ছিলো ফরিদাবাদের তাঁতপল্লী । কিন্তু সেটি কয়েক বছর হলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বর্তমানে তিনি যে পল্লীতে কাজ করেন সেখানে মোট তাঁত সংখ্যা ছিলো ১৮ টি, শুরুতে ১৮ জন তাঁতী কাজ করলেও তারপরে সংখ্যাটি নেমে আসে ১৩ তে, কিন্তু বর্তমানে তিনি সহ এখানে মোট কাজ করেন ০৫ জন তাঁতী ।
এই তাঁতী আরো জানান বর্তমানে এই তাঁত পল্লীতে মূলত পাহাড়ীদের থামি কাপড় বানানো হয়। যা ৪ হাত বহরের, কিন্ত উনারা শাল থেকে শুরু করে সকল কাপড়ই তৈরী করতেন, এবং দৈনিক গড়ে ৮-১০ টি থামি সহ অনান্য পণ্য বানাতে পারতেন যা সম্পূর্ণভাবে হ্যান্ডলুম মেশিনের সাহায্যে করে থাকেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক গড়ে ৫০০ টাকা আয় করেন।
এই তাঁত পল্লীর বর্তমান মালিক মোঃ মামুন এর সাথে কথা বলে জানা যায়,বর্তমানে এই পল্লীর অবস্থা আগের মত নেই, সুতার দাম বাড়তি বান্ডিল প্রতি ৩০০-৪০০ টাকা, এবং এর কদরও কমে যাচ্ছে দিনে দিনে শুধুমাত্র পাহাড়ি এলাকায় বিক্রি করা হয় যার ফলে তাদের খরচ উঠতে হিমশিম অবস্থা হয়ে যায়।
মামুন আরো জানান এক সময়ে তার দাদা করতেন, তারপরে বাবা,বর্তমানে বাবা জীবিত থাকলেও তিনিই এই তাঁত পল্লীর দেখভাল থেকে শুরু করে কাজও করেন।
তিনি বলেন এই পল্লীতে সব রকম তাঁতের পণ্য তৈরী করা যাবে যা আগে আমরা করতাম । কিন্তু বর্তমানে সুতা এবং কারিগরের অভাবে শুধুমাত্র থামি বাননো হয়ে থাকে। এই থামিগুলো মূলত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং লংছড়ি পাহাড়ী অঞ্চলে বেশি বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।
উনি আরো বলেন এখানে মূলত তিন ধরনের সুতা দিয়ে থামি বানানো হয় যার মধ্যে কোরিয়ান সুতা, ইন্ডিয়ান সুতা এবং নরমাল চাইনিজ সুতা দিয়ে বানানো হয়, এই থামিগুলো পাওয়া যায় সিংগেল ও সেট আকারে এবং দামেও রয়েছে তারতম্য।
এই পল্লী কেন অগ্রসর হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এখানে রয়েছে নানাবিধ সমস্যা, মূলত এই এলাকাটি শহরে হলেও অনেকে জানেন না প্রচারের কারণে, তাছাড়া বর্ষাকালে পানি উঠে সেজন্য অনেকে আসতে চায় না, তাঁতীদের অন্য পেশায় চলে যাওয়ার কারণ, মেশিন তাঁত আসাতে কেউ হ্যান্ডলুম তাঁত কদর করতে চায় না, কারণ মেশিনে সময় কম লাগে এবং সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়, তাছাড়া সুতার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া সহ নানামূখী সমস্যা রয়েছে । সর্বোপরী তিনি বলেন সরকারী বেসরকারী পৃষ্ঠাপোষকতার কথা থাকলে তাতে করে সমস্যা গুলো কেটে যাবে বলে উনার অভিমত।
কি করলে এই পল্লীর উন্নয়ন হবে এই কথার জবাবে তিনি বলেন মূলত প্রচারনা তেমন পায়নি বা উনারাও করতে পারেননি, আপনি (আমার কথা বললো) আসাতে হয়তো অনেকে জানতে পারবেন, কিন্তু কেউ অর্ডার করলে আমাদের এখানে শাল থেকে শুরু করে সকল কিছু বানানো যাবে। যদি সুতার দাম কমানো সহ আমাদের কে প্রচারে আনা যায়, তাহলে এই তাঁত পল্লীতে সুদিন আসবে, না হয় এই পল্লী একটা সময়ে বন্ধ করে দিতে হবে বলে তিনি জানান।
বর্তমানে এই তাঁতপল্লীর অনেক সমস্যা আছে তারমধ্যে অন্যতম কাঠামোগত জীর্ণশীর্ণ অবস্থা,কারিগরের অভাব ও প্রচারের অভাব, বর্ষাকালে পানি উঠা সহ অনান্য সমস্যা বিরাজমান রয়েছে ।
যদি এই পল্লীতে পৃষ্ঠপোষকতা করা যায় তাহলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে পূর্বের ন্যায় শাল থেকে শুরু করে থামি সহ অনান্য যেসকল পণ্য রয়েছে সেগুলো ই-কমার্সের বাজারে ব্যাপক সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে, যা ফিরিয়ে আনতে পারে চট্টগ্রামের তাঁত পল্লীর সুদিন।