ব্যস্ততাময় শহরে একটু সময় পেলেই কর্মব্যস্ত মানুষগুলো ভিড় জমায় কোনো খোলা মাঠ কিংবা পার্কে। কংক্রিটের স্থাপনা – উঁচু উঁচু দালানকোঠার ভিড়ে দুই চারটি গাছের দেখা পেলেও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শহুরে এই মানুষগুলো। তেমনি ছোট বড় নানান গাছগাছালিতে ঘেরা চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকাটি যেন ব্যস্ততাময় শহরে প্রাণ সঞ্চারকারী একটি ফুসফুস।
গাছগাছালি ঘেরা ঘন সবুজ উদ্যান শিরীষ তলা, পাহাড়, টিলা, সাত রাস্তার মোরসহ পুরো এলাকাটি জনসমাগমের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনসহ ঐতিহ্যগত নানা উৎসবের অনুষ্ঠানমালা ছাড়াও ছায়া-সুনিবিড় এ এলাকায় নগরীর প্রবীণরা সকাল-বিকাল ভ্রমণ ও ব্যায়াম চর্চা করে থাকেন। শিশু, কিশোর ও যুবকদের খেলাধুলা, বিনোদন তথা মানসিক বিকাশের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত এই সিআরবি এলাকা। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত এই সিআরবি।
ঐতিহ্যবাহী সিআরবি (পূর্ণরুপ – সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) মূলত বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়) মহাব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। এটি চট্টগ্রামের টাইগার পাস সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত। চট্টগ্রামে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ২০০ বছরের ইতিহাসে যে ভবনগুলো তৈরি হয়েছে, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) তার মধ্যে অন্যতম। ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ শাসকরা নবাব মীর কাসিমের কাছ থেকে চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং ভারত বিভাগের আগে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি শাসন করেছিল। তাদের শাসনকালে ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বেশ কয়েকটি ভবন তৈরি করেছিল এবং এই বিল্ডিংগুলির মধ্যে একটি হল সিআরবি। সিআরবি ভবনটি নির্মিত হয় ১৮৭২ সালে এবং এটি বন্দর নগরীর প্রাচীনতম ভবন। ১৮৯৫ সালে ভবনটিকে অবিভক্ত ভারতের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর করা হয়।
এই ভবনের পূর্বদিকে, সিআরবি সড়ক জুড়ে রয়েছে রেলওয়ে হাসপাতাল যা ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সিআরবি পার্শ্ববর্তী স্থানে রেল কর্মকর্তাদের জন্য একটি আবাসিক এলাকাও গড়ে উঠেছে। ১৯৩০ সালের ইতিহাস প্রসিদ্ধ চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থ সংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল এই এলাকায়। এই সিআরবি পাহাড়েই রয়েছে হাতির বাংলো। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুর রবসহ সাতজনে কবর রয়েছে সিআরবি এলাকায়। শুধু তাই নয়, এই এলাকায় আরো রয়েছে ১৮৯৯ সালে ব্যবহৃত প্রথম স্টিম ইঞ্জিন। আর এসব স্থাপনা দেখতেও এখানে প্রতিনিয়ত পর্যটকরা ভিড় জমান।
সিআরবি ঐতিহ্যগতভাবে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি বৃক্ষরাজিতেও অনন্য। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এই এলাকাটি হরেক প্রজাতির পাখ-পাখালি ও প্রাণির আবাস। পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত এ এলাকাটি তাই চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য। সমুদ্রবর্তী নদীবেষ্টিত এই পাহাড়ি নগর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে যুগ যুগ ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটক, ঐতিহাসিক, রাজনীতিক ও আগন্তুকদের মনযোগ ও প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে।
-জুলিয়া আফরোজ
সত্ত্বাধিকারী – বর্ণিল রঙ্গন