দিনাজপুরের বিখ্যাত কাটারিভোগ চাল ভৌগলিক নির্দেশক পন্য হিসেবে এই ২০২১ চলতি বছরেই পুরো বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পেয়ে সমাদৃত হয়েছে। গত জুন মাসের ১৭ তারিখে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অঅধিদপ্তর দিনাজপুরের কাটারি ভোগ চালের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে জিআই সনদ হস্তান্তরিত হয়েছে।
দিনাজপুর জেলা রংপুর বিভাগের একটি প্রাচীন শহর। দিনাজপুরের প্রধান উৎপাদিত শস্য হল ধান। সুগন্ধি চাল উৎপাদনে দিনাজপুর জেলার মত কোন জেলা ই এত এগিয়ে নেই।সুগন্ধি চালের মধ্যে কাটারি ভোগ অন্যতম। দিনাজপুর চালের শহর, কাটারি ভোগ চালের জন্য এক নামে ই বিখ্যাত। দিনাজপুর নিয়ে বাংলায় একটি প্রবাদ ই আছে-
গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু , পুকুর ভরা মাছ ।এই প্রবাদ থেকেই অনুমান করা যায় আমাদের দিনাজপুর প্রাচীনকাল থেকেই বেশ সমৃদ্ধ ছিল।
কাটারি ভোগ চালের উৎপাদন প্রথম কবে নাগাদ শুরু হয় দিনাজপুরে সেটা সঠিক ভাবে কেউ বলতে না পারলেও ধারণা করা যায় যে, আর্য দের দিনাজপুরে আসার আগে থেকেই কাটারি ভোগ চাল উৎপাদিত হয়ে আসছে এখানে। বর্ষাকাল এই ধান লাগানোর উপযুক্ত সময়
কাটারি ভোগ, জিরা কাটারি, জটা কাটারি, ফিলিপাইন কাটারি, চিনি কাটারি, জলপাই কাটারি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সুগন্ধি চাল।
কাটারির চাল দেখেতে সাদা ফটফটে, চিকন এবং মাথা গুলো সুচালো। এই চাল দেখতে ও যেমন সুন্দর আবার ঘ্রাণ ও তেমনি মন মাতানো সুন্দর । এক বাসায় রান্না হলে অন্য বাসায় ও এর মিষ্টি ঘ্রাণ চলে যায়।গোটা বাংলাদেশের মোট উৎপন্ন চালের মধ্যে একটা বড় অংশ ই দিনাজপুর থেকে উৎপাদিত হয়।
অত্যন্ত সুস্বাদু এই চাল। এই চালের তৈরি পোলাও, বিরিয়ানি, পায়েশ, জরদা পোলাও, খিচুড়ির স্বাদ মুখে লেগে থাকার মত।
জেনে খুবই অবাক হবেন যে এই চাল বিদেশে চাষ করলে এটার স্বাদ আর সুগন্ধ দুটোর মান ই কমে যায়। দিনাজপুর ছাড়া এই চাল অন্য কোন এলাকায় ভাল হয় না এমনকি দিনাজপুরের ভেতরে ও সব জায়গায় এটার চাষ হয় না।দিনাজপুর সদর উপজেলার খানপুর, চিরিরবন্দর,ফাশিলাহাট, মুকুন্দপুর, তালপুকুর, রসুলসাহাপুর,কাহারলের কিছু উচু জায়গায় চাষ করে এসব এলাকার চাষিরা।
কাটারি ভোগ চাল প্রায় ১০০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী পন্য হিসেবে পরিচিত ।
কাটারি ভোগ নিয়ে মজার একটা কাহিনি ও ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। মোঘল সম্রাট আওরঙগজেবের আমলের ঘটনা। একবার তিনি দিনাজপুরের রাজা প্রাণ নাথ কে তার দরবারে ডেকেছিলেন। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল দু্র্নীতির জন্য। সম্রাট উনার উপর বেশ ক্ষেপে ই ছিলেন বলা চলে। রাজা প্রাণ নাথ সম্রাটের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় সাথে করে মহা মুল্যবান পাথর, সোনা রুপার মুদ্রার সাথে কাটারি ভোগ চাল ও উপহার হিসেবে নিয়ে যান।সম্রাট নাকি মুল্যবান উপহার গুলির চেয়ে কাটারি ভোগ চাল পেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন। তিনি এত ই খুশি হয়েছিলেন যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার না করে উনাকে বরঞ্চ উল্টো ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে সম্মান দিয়েছিলেন। গল্পটার সত্যমিথ্যা কিনা জানিনা তবে গল্পটি পড়ে বুঝতে পারছি কাটারি ভোগ চাল কিন্তু উপহার হিসেবেও বেশ দারুণ হতে পারে বর্তমানকালেও।
দিনাজপুর সদরে রসুলসাহাপুর গ্রামের এক জনৈক কৃষক ওফিসউদ্দিন বলেন, মোটা চালের চেয়ে কাটারি চালের দাম দ্বিগুণ তাই কাটারি চাষ করে উনাদের লাভ ও ভাল হয়৷ তিনি এটাও বলেন যে, কাটারি ভোগ চাষের মাধ্যমে ই উনার পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে।
কাটারিভোগ চাল নিয়ে আমার নিজের ব্যক্তিগত একটা স্মৃতি শেয়ার করতে চাই। ২০১৮ সালে ভাইয়ের কাছে আমেরিকা গিয়েছিলাম। সেখানে নিত্যদিনের বাজার করতে একটা বাঙালি কমিউনিটির এক শপে গেছিলাম। বাসার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এক এক করে নিচ্ছিলাম হঠাৎ করে নজর গেল চালের সেকশনে।
বস্তায় বড় করে লিখা
‘ দিনাজপুরের বিখ্যাত কাটারিভোগ চাল ‘ লিখাটা দেখেই ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের কিছু দেখলে কি যে ভাল লাগে তা লিখে বুঝাতে পারব না।
বিশ্ব আজ ই -কমার্স এর অবদানে হাতের মুঠোয় চলে এসেছ।ঘরে বসেই মুহূর্তের মধ্যে যে কোন পন্য অর্ডার করলেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায় আংগুলের ইশারায় যেন। চাল যেহেতু শুকনো খাবার তাই ডেলিভারিতে ঝুকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।দিনাজপুরের এই ঐতিহ্যবাহী পন্য নিয়ে কাজ করে বহু উদ্যোক্তা ই পারেন ই- কমার্স কে কাজে লাগিয়ে এই চাল কে দেশে বিদেশে মানুষের দোর গোড়ায় পৌছে দিতে।