বেড়ে উঠার শুরুটা গ্রামে । যেখানে খেলার সাথী ছিলো খোলা মাঠ ,পাহাড় ,আর খিলখিলিয়ে হেসে বেড়ানোর উপজাতি বন্ধুরা । ক্ষুধা পেলে বাড়ি ফিরতে হবে বলে কোনো তাড়া আমাদের কখনোই থাকতো না কারণ আমরা বুনোখাদ্যের সুবিশাল ভান্ডার ভাওয়াল গড়ের সন্তান । ক্ষুধা পেলে মাটি খুড়লেই আমরা পেয়ে যেতাম গারো আলু ,গাতি আলু ,গাইজা আলু সহ হরেক রকমের মিষ্টি ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ আলু ।যা মাটি থেকে তুলে ধুয়ে কখনো আগুনে পুড়ে, কখনো কাঁচা , কখনো লবন মরিচ মাখিয়ে নিয়ে দৌড়ে যেতাম গাছের উপরে তৈরি করা সেই টং ঘরে। নিচের দিকে দু পা ঝুলিয়ে বন্ধুদের সেই আনন্দে আত্মহারা হওয়া দিনগুলো যেমন আজ নেই তেমনি ভাবে আমরা হারিয়েছি আমাদের সেই বুনো আলু গুলোও ।
মধুপুরের গারো সম্প্রদায়ের ভূমিজুড়ে পাওয়া এই আলু ছিলো গোটা সম্প্রদায়ের প্রাকৃতিক আহার । ধীরে বন ধ্বংস হওয়া শুরু হলে সাথে সাথে শুরু হয় বুনোখাদ্য হারিয়ে যাওয়ার দিন ।বনে পাওয়া সবধরনের আলুর মধ্যে ভাওয়ালের সব মানুষের মন জয় করে একটা আলু ।যাকে গারো সম্প্রদায় থামান্দি বা থা.বালচু বলে থাকলেও অন্যান্যরা বলে থাকেন শিমলাই আলু।
মধুপুরের শালবন থেকে প্রথমে গারোরা এই আলুর সন্ধান পান ,তখন থেকেই পরিচিত হয় গারো আলু নামে । কিন্তু ধীরে ধীরে এটার আসল নাম জানা যায় । আদিবাসী গারোদের বসবাস ছিলো বনের কাছেই ।তারা বনের গাছ গুলোতে বাঁশ ও ছনের ছাউনি দিয়ে ঘর(মাচাং) বানিয়ে থাকতেন এবং খাবারের সংকট দেখা গেলে পিঠে বাচ্চা বেঁধে (আমরা যেমন চা বাগানে দেখি )হাতে খুন্তি, মধুপুরের ভাষায় জুঙ্গা (বাঁশের তৈরি ব্যাগ ) নিয়ে মান্দি গানের সুর তোলে রমনীরা বের হয়ে যায় । ঘন্টা দুয়েক সময় দিলেই পেয়ে যেতো সারাদিনের খাবার।
আচিক সম্প্রদায়ের দিনাতিপাত চলে যেতো এভাবেই।ঝর্নার পানি ও বুনোখাদ্যের সমাহার থাকায় তাদের কখনোই বুঝতে হয়নি এই ভাওয়ালেও খাবার সংকট ও কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবতে হতে পারে।একটা সময় শুরু হয় বন নিধন ।বুনো আলু পাওয়া তো দূরের কথা জ্বালানির সমস্যাও দেখা দিতে থাকে।
গারো সম্প্রদায় প্রথমে বেশ হতাশ হন,একের পর এক সমস্যার সমাধান করে উঠতে না পেরে নিজেদের খাবার জোটাতেই মূলত শুরু করেন থা বালচু বা গারো আলুর বাণিজ্যিক চাষাবাদ। বছর পাঁচেক আগেও থা বালচু বলতে শুধুমাত্র গারোপাড়ায় পরিচিত ছিলো।এরপর গারোদের পরিচিতির একটা মাধ্যম হলো তাদের আতিথেয়তা ।কেউ তাদের বাসায় ঘুরতে গেলে এককাপ চায়ের সাথে একটু থা. বালচু ও দিতেন। এতো বেশি মজার এই আলু যে সবার ভালো লেগে যায় এবং কেনার আগ্রহ দেখায় ।এভাবেই পুরো ভাওয়াল মধুপুরে এই আলু পরিচিতি পায় । কিন্তু তারপরও কোথায় যেনো সমস্যা রয়েই যায় ।
এখনও পর্যন্ত ভাওয়ালের গন্ডি ছেড়ে বেড়োয়নি এই থা.বালচু ।আমরা গুগল সার্চ করলে দেখা যায় মাএ দুটো লিখা ।যার একটা মধুপুরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে অন্যটি টেকজুম টিভিতে নারীগারোদের কাজ নিয়ে লিখা আমার আর্টিকেলে ।এ থেকেই বুঝা যায় থা. বালচু কতোটা পিছিয়ে । এতোটা সহজ ও সুবিধাজনক ব্যবসা হওয়ার পরও নারীরা এগুতে পারেনি ।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কি এই থা.বালচু যা নিয়ে ভাওয়ালের মানুষের এতো মাতামাতি ।তাই বলছি শুনুন আমাদের থা.বালচু নিয়ে।
⭐ থা.বালচু কি ??
থা .বালচু কান্ডজাতীয় একটি আলু । চৈত্র মাসের মধ্যে থা.বালচু গাছের ছাল কেটে গারোরা পুকুরের পানিতে ফেলে রাখে শিকড় আসার জন্য।প্রায় একমাস সময় নিয়ে ওই ডালগুলোতে শিকড় আসে তখন ডালগুলো অন্যান্য গাছের মতো করে লাগিয়ে দেয়া হয় পাহাড়ের ডাল বা যেকোনো শুকনো মাটিতে ।কেউ কেউ মিশ্রচাষ করে থাকে ।যেমন- আনারস,আদা, হলুদ একসাথে চাষ করে এবং মাঝে মাঝে একদুটো থা বালচুর ডাল লাগিয়ে দেয়।
⭐ থা. বালচু চাষে গারোরা কোনো ক্ষতিকর মেডিসিন ব্যাবহার করে কিনা
এই প্রশ্নের উত্তরে একদম ক্লিয়ারকাট জবাব হবে “”না”””
গারো আলু আজীবন প্রাকৃতিক পরিবেশে মুক্তভাবে বড় হয়েছে এখনও তাই হয় ।এই আলুর ডাল লাগানোর পর চাষী একপ্রকার ঘুমিয়েই থাকে বলা যায় ।কারণ ডাল লাগিয়ে দেওয়ার পর এখানে কোনো কাজ নেই আর ।ডালগুলো প্রকৃতির নিয়মেই বড় হয় , এতোটা ফ্রেশ খাবার আজও আছে কিনা সন্দেহ !!
⭐কখন সংগ্রহ করা হয়
গ্রীষ্মের শেষের দিকে থা.বালচুর ডাল কেটে ফেলা হয় নতুন গাছ তৈরির জন্য এবং পুরাতন গাছের শিকড় খুড়ে মাটির নিচ থেকে সংগ্রহ করা হয় আলু ।
গ্রামের ভাষায় মধুপুরের মানুষ একটা কথা বলে থাকে এজন্য ,
লালমাটি থেকে আমরা সোনা সংগ্রহ করি ।
মধুপুরের মাটি লালচে । এখানের মাটিতে এমন কোনো শস্য নেই যে হয়না ,তাই মধুপুরের মানুষ নিজেদের লাকি মনে করেই এই কথা বলে থাকেন।
⭐ থা বালচু স্বাদে কেমন
থা .বালচু কাঁচা ও সিদ্ধ দু ভাবেই খাওয়া যায় । কাঁচা খেতে হালকা বালি বালি এবং বেশ রসালো টাইপ হয় ।মরিচ ও লবন দিয়ে খেতে বেশ টেষ্টি । তবে পারফেক্ট হয় সিদ্ধ করে খাওয়াটা ।খোসা ছিলে হালকা লবন দিয়ে সিদ্ধ করে নিলে রসালো ভাবটা থাকে না বরং একটু আঠালো হয়ে ।স্বাদের কথা বলতে গেলে মিষ্টি একটা গন্ধই আপনাকে মাতোয়া করে দিবে । এককথায় আপনি ফ্যান হয়ে যাবেন এই আলুর।
⭐ পরিচিতি ছাড়াও বাণিজ্যিক চাষে কিভাবে লাভবান হচ্ছে চাষীরা
হতাশার পথ ছাড়তেই যারা গারো আলুর লাঠি ও মাটিকে আপন করেছিলো আজ তারা খুশি মনেই কাজ করে যায়।থা বালচু মধুপুরের গন্ডি পেরিয়ে তেমন পরিচিত না কিন্তু গারোদের চেষ্টায় যতোটা পরিচিত হয়েছে এবং গারো আলু তার স্বাদ দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে তাতে করে সিজনে গারোরা ক্রেতার চাহিদা মেটাতে হিমসিম খায় ।
গারোদের অবস্থা এখন উন্নত বলা চলে । অনেকেই যার যার পেশায় চলে গেছে ।অল্প সংখ্যক গারো এখন এই আলু চাষ করে থাকে ।বিক্রেতা কমলেও তো ক্রেতা কমেনি ।কেউ কেউ নিজেদের চাহিদা মেটাতে নিজেরাই চাষ করছেন।
গারো আলু চাষ করা মানেই লাভ । এখানে শূন্য পয়সাও খরচ করতে হয় না , আলহামদুলিল্লাহ ।যার কারণেই অল্পতেই অবস্থা পাল্টে গেছে ।গারো
গারো আলুর দিন ফেরাতে হবে আমাদের কেই ।কেননা পরিচিতির মুখ দেখার আগেই যদি বিলিন হতে থাকে তাহলে সেই লস টা আমাদেরই । সারাদেশে এখনও জানাই হয়নি যে থা বালচু বলে কিছু আছে ,তার প্রাকৃতিক গুনাগুণ এতো ,এতোটা ফ্রেশ এবং খরচবিহীন ফসল।গারো আলুর পরিচিতির পাতায় একটা একটা করে লিখা যোগ হোক । এগিয়ে যাক আমাদের কৃষি আমাদের সম্প্রদায় ।
আমিনা
ওনার অফ অপরাজিতা