মানিকগঞ্জে তাঁতের শাড়ি ও শাড়ির মান অজানাই ছিলো শাড়ির প্রেমিদের কাছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি) ও ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর যৌথ উদ্যোগে ‘ডিজিটাল পল্লী’র প্রজেক্টের মাধ্যমে ইন্টারনেট জুড়ে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির পরিচিতি বিস্তার লাভ করেছে।
আগামী ২৯ মে (রবিবার) ডিজিটাল পল্লী প্রজেক্টের অধীনে ধানমন্ডির ম্যারিয়ট কনভেনশন সেন্টারে ‘ডিজিটাল কমার্স মেলা’র যৌথ আয়োজন করছে বিপিসি ও ই-ক্যাব। মেলায় অংশগ্রহণ করা স্টলের মধ্যে ২০ টিতে থাকছে শুধুমাত্র মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা । এই ২০ স্টলের উদ্যোক্তাদের মতামত ধারাবাহিক ভাবে তোলে ধরছেন আওয়ার শেরপুর এর প্রতিষ্ঠাতা মোঃ দেলোয়ার হোসেন।
দিনাজপুর থেকে কাজ করেন ঘরকুনো সিনজিনির স্বত্বাধিকারী খুরশিদা ইসলাম রুকু। ডিজিটাল কমার্স মেলায় তার স্টলে থাকছে শুধু মাত্র মানিকগঞ্জ তাঁতের শাড়ি। নিজের পণ্যের পরিবর্তে মানিকগঞ্জের শাড়ির প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমি কাজ করছি দিনাজপুরের আম ও রাজশাহী সিল্ক শাড়ি নিয়ে। তবে আসন্ন ডিজিটাল কমার্স মেলায় মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ি নিয়ে অংশগ্রহণ করেছি। আর এটিই হতে যাচ্ছে মেলায় অংশগ্রহণের আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
তিনি আরও বলেন, তাঁত ও দেশি পণ্যের প্রতি ভালোলাগা থেকে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়িকে সহযোগীতা করছি। আঞ্চলিক পণ্যের পরিচিতি বাড়াতে যত বেশি সহযোগীতা করতে পারবো দেশি পণ্যের পরিচিতি ও ব্যবহার তত বাড়বে। এতে আমার জেলা পণ্যের কদর বাড়বে।
ক্যামেলিয়ার স্বত্বাধিকারী ফারজানা আফরোজ রত্না। কাপড়ে আকাআকি বা হ্যান্ডপেইন্টিং নিয়ে রত্নার উদ্যোগ। ডিজিটাল কামর্স মেলায় রত্নার স্টলে শুধুমাত্র মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ২২ থেকে ৩৪ রকমের শাড়ি বুনা হয় তা অজানাই ছিল। ডিজিটাল পল্লী প্রকল্পের মাধ্যমে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ি চিনতে ও ব্যবহার করতে পারছি।
রত্না আরও বলেন, মানিকগঞ্জ জেলার তাঁত শিল্পের প্রচারনার অংশ হতে ডিজিটাল কমার্স মেলায় স্টল নিয়েছি। তাই মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্ট করে আমার স্টলে প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা রাখছি। দেশের নির্দিষ্ট একটি জেলার তাঁত শিল্পের প্রচারণায় ক্ষুদ্র অংশ হতে পেরে আমি আনন্দিত।
ব্লক-বাটিক নিয়ে কাজ করেন আকৃতা’র স্বত্বাধিকারী সঞ্চিতা বসাক। মেলায় তার স্টলেও থাকছে শুধুমাত্র মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ি। এ নিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল কমার্স মেলায় স্টল নিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। সঞ্চিতা বসাক আরও বলেন, দেশের এমন একটি জেলার তাঁত শিল্পের প্রচারে সুযোগ পাচ্ছি, যা এতদিন ছিল অবহেলিত। এরফলে মানিকগঞ্জের তাঁত পণ্যের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং ও মার্কেট তৈরি হয় নি। মেলায় অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো- মানিকগঞ্জের তাঁত শিল্পের ব্র্যান্ডিং শক্তিশালী করা। যেন নিজ জেলার নামেই পরিচিতি পায় মানিকগঞ্জের তাঁত পণ্য।
গয়না-শাড়ি নিয়ে কাজ করেন রূপ’স হ্যাভেনের স্বত্বাধিকারী মেহজাবীন রাখী। ডিজিটাল কমার্স মেলায় মানিকগঞ্জের শাড়ি নিয়ে থাকা ২০ টি স্টলের মধ্যে রয়েছে রাখীর স্টল। এই উদ্যোক্তা বলেন, যেহেতু মেলার মাধ্যমে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ি প্রচারের সুযোগ রয়েছে তাই এতে প্রাধান্য দিচ্ছি। এই শাড়ির প্রচার ও পরিচিতি বাড়াতে বেশ কিছুদিন ধরে নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এই মেলা থেকে নিজেকে নতুন একটি অভিজ্ঞতা দিতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। রাখী ডিজিটাল পল্লী প্রকল্প ও ডিজিটাল কমার্স মেলা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
জাকিয়া’স ড্রীমের স্বত্বাধিকারী জাকিয়া ফেরদৌস। কাজ করেন দেশি শাড়ি নিয়ে। তবে ডিজিটাল পল্লী সম্পর্কে জানার মাধ্যমে তিনি উদ্যোমী হয়েছে ডিজিটাল কমার্স মেলায় মানিকগঞ্জের শাড়ির স্টল দিতে। ইতিমধ্যে মেলায় স্টল দেওয়ার অনুমোদন মিলেছে জাকিয়ার। বহুবছর আগে থেকে সাটুরিয়ার তাঁত পল্লীতে ২২ ধরণের বেশি তাঁতের শাড়ি বুনা হয় তা প্রচারের অভাবে দেশবাসীর কাছে ছিল অজানা। গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে বাজার চাহিদাও তুঙ্গে। অথচ বিভিন্ন কারণে বন্ধ হতে চলছে মানিকগঞ্জের তাঁত শিল্প। ডিজিটাল পল্লী প্রজেক্টের কারণে মানিকগঞ্জের তাঁত পণ্যের শক্তিশালী ব্র্যান্ডিং গড়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করেন জাকিয়া। এই প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিপিসি ও ই-ক্যাব কে আন্তরিক ধন্যবাদ দেন।
নান্দনিক কালেকশনের স্বত্বাধিকারী মিনা ভৌমিক। কাজ করেন দেশি পণ্য নিয়ে। তিনি বলেন, ডিজিটাল কমার্স মেলায় অংশগ্রহণ করতে পেরে খুব আনন্দিত ও গর্বিত। এই মেলাকে ঘিরে মানিকগঞ্জের তাঁত পণ্যের প্রচার ও পরিচিতি বাড়বে। জেলার নামে পরিচিতি পাবে মানিকগঞ্জের তাঁত শিল্প। সেই প্রত্যাশা থেকে আমি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মেলায় অংশগ্রহণ করছি। প্রচারের মাধ্যমে দেশে বিদেশে সমাদৃত হোক মানিকগঞ্জের তাঁত শিল্প। তিনি আরও বলেন, এই প্রথম কোন মেলায় অংশগ্রহণ করছি। তাই আমি ভীষণ এক্সাইটেড।
রিংকি’স এ্যটায়ারের স্বত্বাধিকারী রেহমুমা হোসেন রিংকি জানালেন ভিন্ন কথা। এই উদ্যোক্তা জানালেন, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তাঁত পল্লীতে মসলিন থেকে শুরু করে বালুচুরী, কোটা, হাফসিল্ক, সফ্ট সিল্ক, জামদানি, দোতারি, রেশমী, সালোয়ার কামিজ, গজ কাপড়, লুঙ্গি, গামছা এবং মণিপুরী শাড়ি তৈরি করা হয়। মানিকগঞ্জের তাঁতের সাথে জেলার নাম জুড়ে যাবে এইটাই তার প্রত্যাশা। একজন দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে ডিজিটাল পল্লীর ঢেউয়ে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির প্রচার করা নিজের দায়বদ্ধতা বলে গণ্য করেন রিংকি।
আলিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী জেনিস ফারজানা তানিয়া টেকজুম কে বলেন, ডিজিটাল কমার্স মেলায় স্টল পেয়ে আমার খুবই ভালো লাগছে। এ মেলার মাধ্যমে সরকারের ডিজিটাল পল্লী প্রজেক্টে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির প্রচারণার অংশ হতে পেরে আমি আনন্দিত। আমার স্টলে শুধুমাত্র সাটুরিয়ার তাঁতের শাড়ির প্রদর্শনী ও বিক্রির সুযোগ রাখছি। তবে মেলার আগেই সারাদেশ থেকে ক্রেতারা স্টলের শাড়ি অর্ডার করছেন।
ময়মনসিংহের উদ্যোক্তা আরিফা খাতুন। কাজ করছেন ঢাকাইয়া জামদানি নিয়ে। তার উদ্যোগের নাম আফাফ ক্রিয়েশনস। তিনি টেকজুম কে বলেন, মানিকগঞ্জের শাড়ি সম্পর্কে জেনেছি মাত্র কয়েকদিন আগে। শাড়ির রঙ, সুতা, কাজের কোয়ালিটিও বেশ ভালো। মানিকগঞ্জের তাঁতপল্লীর সম্ভাবণা অনেক বেশি। তাই আমরা সবাই মিলে বিভিন্ন ভাবে প্রচার করছি, যেন এই তাঁত শিল্প আবার ওঠে আসে। ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়ে গেছে এবং শাড়ি বিক্রিও ভালো হচ্ছে। ডিজিটাল পল্লী থেকে যে মেলা আয়োজন হচ্ছে সেখানে আমার স্টলেও শুধু মানিকগঞ্জের শাড়ি থাকবে। মানিকগঞ্জের শাড়ি প্রচারের অংশ হতে পেরে ভালো লাগা কাজ করছে।
মাধবীর স্বত্বাধিকারী সেতু পোদ্দার একজন দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা। আসন্ন ডিজিটাল কমার্স মেলায় তিনিও স্টল দিচ্ছেন মানিকগঞ্জের শাড়ি নিয়ে। এ নিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল পল্লী প্রজেক্টের ‘ডিজিটাল কমার্স মেলা’য় আমার স্টল নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। মূলত মেলা টি হচ্ছে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির প্রচারের লক্ষ্যে। মানিকগঞ্জের তাঁত শিল্প খুব সমৃদ্ধ। শুধু মাত্র তাদের পরিচিতি, বাজার ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান নেই বলেই মানুষ জানতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, একজন দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে মানিকগঞ্জের তাঁতের শাড়ির প্রচারে সহযোগিতা করা দায়িত্ব মনে করি। একটি জেলার সম্ভাবনাময় তাঁত শিল্প উঠে আসলে উদ্যোক্তা, কর্মসংস্থান এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। মানিকগঞ্জের তাঁতিরা নিজস্বতা ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে। ডিজিটাল ই-কমার্স মেলায় স্টল নেওয়ার মাধ্যমে মানিকগঞ্জের তাঁত পণ্যের প্রচারে অংশ হতে পেরে আমি সত্যি গর্বিত।