বর্তমান সময়টাকে বলা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। আর সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দুই কোটির বেশি।
এদিকে ফেসবুকের এ জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অসাধু চক্র মেতে উঠেছে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে। বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে, নোংরা ছবি-ভিডিও আপলোড করে নারীদের হয়রানি, গুজব ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো, প্রশ্নফাঁসসহ গুরুতর অপরাধগুলো সংঘটিত করছে ফেসবুকের মাধ্যমে।
এ ফেসবুকের নীল বিষে আক্রান্ত যুবসমাজ। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে স্কুল চলাকালেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী আবার এটি ব্যবহার করছে পাঠদান চলাকালে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যধিক আসক্তি কমিয়ে দিচ্ছে পড়ালেখায় মনোযোগ। এতে শিক্ষার্থীদের ফলাফল যেমন খারাপ হচ্ছে, তেমনি সার্বিকভাবে পড়ালেখায় পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।
কেউ হয়রানির শিকার হলে
ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে দিন দিন সাইবার ক্রাইমের পরিমাণও বাড়ছে। অপরাধীরা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করছে। অনেক ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বা সামাজিকভাবে হেয় করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ হয়রানি শিকার হলে কী করবেন এমন প্রশ্নে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার (ডিসি) আলীমুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, কেউ যদি সাইবার অপরাধের শিকার হন তাহলে তাকে প্রথমেই পুলিশে রিপোর্ট করতে হবে। আবার ঢাকা মহানগর হলে ডিএমপিতে আমাদের সাইবার ক্রাইম ইউনিট কাজ করছে। এখানেও অভিযোগ জানানো যাবে। ঢাকার বাইরে হলে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করতে হবে। ঢাকা মহানগরে যোগাযোগের জন্য আমাদের ফেসবুক পেজে (https:/ww/w.facebook.com/ cyberctdmp) যোগাযোগ করা যেতে পারে। আমাদের হেল্প ডেস্ক নাম্বারও খোলা থাকে (০১৭৬৯৬৯১৫২২)। কারও ফেসবুক বা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হলেও সেটা পুনরুদ্ধারের সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে ভিকটিমকে সাপোর্ট করি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে অনেক কিছুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেন্দ্রিক। প্রত্যেকের মেইল, ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যমের আইডি গুরুত্বপূর্ণ। এ সবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে নিজের সচেতনতা প্রয়োজন। মেইলের পাসওয়ার্ড বা অন্যান্য জিনিসগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না, টু-ফ্যাক্টর সিকিউরিটি চালু করতে হবে। কোনো কন্টেন্ট বিশেষ করে ভিডিও কন্টেন্ট আপলোড বা শেয়ারের ক্ষেত্রে অবশ্যই কপিরাইটের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সহজ পাসওয়ার্ড না দিয়ে একটু কঠিন পাসওয়ার্ড দিতে হবে। কোনো লিঙ্কে ক্লিক করার আগে ভেবে চিন্তে করতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই পাসওয়ার্ড চাইলে দেয়া যাবে না।
প্রতিঘণ্টায় আপলোড হচ্ছে ৩০ কোটি ছবি
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৪১ কোটি। যা গত বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ১৫৯ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত ফেসবুকে লগ ইন করেন এবং তারাই অ্যাকটিভ ইউজার। কেবল মোবাইলের অ্যাকটিভ ব্যবহারকারী ১৭৪ কোটি। তবে সিএনএনের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এ প্রোফাইলগুলোর মধ্যে ফেক প্রোফাইল ৮ কোটি ৩০ লাখ। যার অধিকাংশই নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত করছে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীর শতকরা হার ২৯.৭ শতাংশ। গবেষণা অনুযায়ী, ফেসবুকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ কোটি ফটো আপলোড করা হয়। আর ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ মিনিট সময় কাটান ফেসবুকে। এক মিনিটে ফেসবুকে কমেন্ট জমা পড়ে ৫ লাখ, স্টাটাস আপডেট হয় ২ লাখ ৯৩ হাজার। এসব পরিসংখ্যানই বলে দেয় ফেসবুক কীভাবে প্রত্যেকের জীবনে সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
বিভিন্ন গ্রুপে বিকৃত যৌনচর্চা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে চলছে বিকৃত যৌনচর্চা। অনেক সময় গ্রুপ পাবলিক রেখে বা ক্লোজড করে দিয়ে একটা সংঘবদ্ধ চক্র যৌনাচার করছেন। এসব গ্রুপে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মেয়ের নোংরা-নগ্ন ছবি পোস্ট করে নানা রকম মন্তব্য করতে বলা হয়। অনেক সময় গোপনে ধারণ করা ছবিও পোস্ট করা হয়। রাতের গভীরতা বাড়লেই এসব গ্রুপের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। অনেক সময় প্রকাশ্যেই বলা হয়, এখন কি কেউ জেগে আছেন? সেক্স চ্যাট করতে চাই। অনেক সময় বিভিন্ন মেয়ের আইডি থেকে উত্তেজক ছবি পোস্ট করে ফোন নাম্বার দিয়ে দেয়া হয়। অনেকে আবার প্রতি ঘণ্টা বা রাতের হিসাব করে যৌন কাজের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেন। গ্রুপগুলোয় এক ধরনের পোস্ট প্রায়ই দেখা যায়। যেমন- একটি স্বল্প বসনা নারীর ছবি দিয়ে বলা হয়, জামাটি খুব সুন্দর। আবার বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শপিংমলে ঘুরতে বের হওয়া অপ্রস্তুত অবস্থায় ধারণ করা মেয়েদের ছবি পোস্ট করে বলা হয় ‘কার কার লাগবে এমন জিনিস’। এভাবে ওই মেয়ে বা মহিলার অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ছে ওই মেয়ের ছবি। অনেকে আবার সেক্স চ্যাট করার জন্য প্রকাশ্যেই পাটনার খুঁজছেন। ফেসবুকে ইংরেজি বা বাংলা দুভাবেই সার্চ দিলে এরকম অসংখ্য গ্রুপ বা প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে। এসব বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট বিভিন্ন সময় গ্রেফতার মামলা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সতর্ক করলেও এসব বিকৃত যৌনচর্চা কমেনি।
ইদানীং সবচেয়ে ভয়াবহ এবং বিব্রতকর বিষয়টি হল গভীর রাতে ফেসবুক লাইভ। রাত গভীর হলে বিভিন্ন গ্রুপে একদল নারী স্বল্প বসনা হয়ে ফেসবুক লাইভে আসেন। এ সময় তারা বিভিন্ন উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি করেন। অনেক সময় টাকার বিনিময়ে সেক্সচ্যাট কিংবা নাম্বার আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভিডিও কলের অফার দেন। এসব আর্থিক লেনদেনে অনেকে আবার প্রতারিতও হয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, কয়েকদিন আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপে একটি মেয়ে লাইভে এসে নানারকম উত্তেজক কথা বলেন। এরপর তিনি বলেন, ৫০০ টাকা বিকাশ করলে ইমো নাম্বার দেয়া হবে। কথা মতো ৫০০ টাকা বিকাশ করলেও তার ইমো নাম্বার পাইনি। বিকাশের নাম্বারটিও কয়েকঘণ্টা পর বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় এ কথা কাউকে বলতেও পারি না।
গুজবের হাট
ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এখন থেকে ছড়ানো হচ্ছে ধর্মীয় বিদ্বেষ আর বিভিন্ন গুজব। এখন পর্যন্ত দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করে যতগুলো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সবই ফেসবুক থেকে। সর্বশেষ ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপের সময় গুজব ছড়ানো হয়েছিল, একযোগে বেসিনে ৫০০ এমএল হারপিক ফেললে মশা দমন করা যাবে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটি শক্ত হাতে দমন করে। ২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা সাত দিনব্যাপী সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে আন্দোলন ঘিরে নানা ধরনের গুজবও ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন পোস্টে গুজব ছড়ানো হয়, শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও ছাত্রী ধর্ষণের। পরে পুলিশ অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়।
২০১৭ সালের নভেম্বরে ফেসবুকের গুজবের সূত্র ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। এর আগে ২০১২ সালের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননা করে ছবি সংযুক্ত করায় রামু উপজেলার বৌদ্ধ বসতি এলাকায় চালানো হয় তাণ্ডব। এ সময় ১২টি বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধদের ৩০টি বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছিল। শতাধিক ঘরবাড়ি এবং দোকানপাটে হামলা ও লুটপাট চালায় সুযোগ সন্ধানীরা। এ ছাড়া কুমিল্লার হোমনা, পাবনার সাঁথিয়া, সাতক্ষীরার ফতেহপুরে এমন গুজব থেকেই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে।
ফেসবুক ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় মেডিকেলসহ বিভিন্ন পাবলিক ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন, এসএসসি, এইচএসসি এমনকি জেডিসি বা জেএসসি পরীক্ষারও প্রশ্নফাঁস কিংবা গুজব ছড়িয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।
আক্রান্ত বেশি নারীরা
সাম্প্রতিক বেশ কিছু হিসাব বলছে, দেশের অনলাইন ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনো ধরনের হয়রানির শিকার। শুধু দেশই নয়, বিশ্বজুড়ে অনলাইনে নারী হয়রানির এমন ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার নিরাপত্তা শাখার তথ্যমতে, তথ্যপ্রযুক্তি অবাধ বিচরণের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ভূমিকা রাখছে আবার এসব মাধ্যমে নারী হয়রানির ঘটনাও বাড়ছে। পুলিশের দাবি, অভিযোগকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট থেকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী সাদেকা হালিম বলেন, অনলাইনে ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি। প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের হয়রানি কমবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন টিনএজ নারীরা। এ বয়সের একটি আবেগ থাকে। এ কারণে তারা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিও তুলছেন। বন্ধুরা সেসব ছবি ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে তাকে হয়রানি বা ব্ল্যাকমেইল করছে। এ জন্য বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। হয়রানির শিকার নারীদের আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরি বলেও মত দেন তিনি।
মাদকের চেয়েও ভয়াবহ সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সময়ে ছোট-বড় সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এ আসক্তির মাত্রা মাদকের চেয়েও ভয়াবহ। আশপাশে একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, অনেকেই পাঁচ মিনিট পর পর ফেসবুকে ঢুকছেন, নোটিফিকেশন চেক করছেন। এটা করতে না পারলেই কিন্তু তারা অস্থির হয়ে পড়বেন। বিষয়টা এমন যেন ফেসবুক বা টুইটারই জীবনের সব। এটা না হলে চলবেই না। এই আসক্তি মাদকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তিনি বলেন, ইন্টারনেটের এ যুগে অবশ্যই আপনাকে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমেও বিচরণ করতে হবে। তবে সেটা অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট মাত্রায়। কোনো কাজের ক্ষতি করে নয়। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ পাঁচ মিনিটের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছেন। এটা অবশ্যই ক্ষতি এবং সময়ের অপচয়। আজকাল রাতের পর রাত জেগে বাচ্চারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকছে। এতে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। অনেকে অফিসে গিয়ে বা কাজের মধ্যে ফেসবুক চালাচ্ছেন এভাবে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
মনোবিজ্ঞানী মেহজাবীন হক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে বিশেষ করে পরিবারের ভেতরেও নানা রকমের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনগুলো ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক কোনো আড্ডায় কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। যে যার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। বাস্তবিক সম্পর্কের চেয়েও ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলো যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এভাবেই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক হচ্ছে, একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। পাশাপাশি একে অপরের সঙ্গে এক ধরনের প্রতিযোগিতারও সৃষ্টি হচ্ছে। এক পর্যায়ে ডিপ্রেশন বা মানসিক রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এ ইন্টারনেট আসক্তি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে শিশুদের। শুধু পড়ালেখা নয়, অধিক সময় ধরে মোবাইল ব্যবহারের কারণে তাদের মনোদৈহিক নানা সমস্যা তৈরি হয়। অনেকক্ষণ স্থির বসে কিংবা শুয়ে থাকায় তাদের শারীরিক সচলতা কম হয়। ফলে ঘাড় ব্যথা যেমন হয়, তেমনি বাড়ে স্থূলতা। এতে তারা শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। আবার মানসিকভাবেও তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, অপরাধ প্রবণতা।
এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে প্রথম পদক্ষেপ পরিবার থেকেই নিতে হবে বলে জানান এ মনোবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেয়ার আগে তাকে সময় বেঁধে দিন। সে কি করছে সে বিষয়ে মনিটরিং করুন। ১৮ বছরের আগে স্মার্টফোন তুলে না দেয়াই উত্তম। দিলেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করুন। সন্তানদের সামনে মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেরাও সতর্ক থাকুন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেছেন, ফেসবুক আসক্তি এখন একটা নেশা। এটি ‘ডিজিটাল কোকেন’ অ্যাডিকশনের মতো হয়ে গেছে। আজকাল তরুণ প্রজন্ম একবার ফেসবুকের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে চায় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন। ফেসবুককে ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, আমি দেখেছি ইয়াঙ্গার জেনারেশনের ভেতরে ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করে ফেসবুক চ্যাটিং করার জন্য। এটি ক্রিয়েটিভ ইউজ নয়। তরুণদের ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয়ও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা থেকে শুরু করে ঘুম কম হওয়াসহ নানা অসুস্থতার জন্যও একে দায়ী করা হচ্ছে। কাজেই ফেসবুক ব্যবহারে প্রয়োজন সচেতনতা। আর শিশু কিংবা উঠতি বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহারে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা।