বৈশ্বিক সার্চ জায়ান্ট গুগলের পাশাপাশি প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছেন সুন্দর পিচাই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ প্রকৌশলীকে এমন এক সময় অ্যালফাবেটের সিইওর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যখন গুগলের কার্যক্রম নিয়ে খোদ কর্মীদের মধ্যেই আস্থা সংকট তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত এক দশকে গুগলের কর্মী সংখ্যা বেড়েছে আট গুণ। বিশাল কর্মী বাহিনীর গুগল পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে সুন্দর পিচাইকে। তিনি অ্যালফাবেটের সিইওর দায়িত্ব নেয়ার পর কর্মীদের অনেকেরই অভিযোগ, গুগল বদলে গেছে। তারা প্রথম যখন যোগদান করেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি এখন সে রকম নেই।
অ্যালফাবেটে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এমন কর্মীদের অনেকে সিএনবিসিকে জানায়, সাংগঠনিক রদবদল ও একাধিক পরিবর্তনের কারণে তারা প্রথম যখন যোগদান করেছিলেন, সেভাবে আর কখনই গুগলকে দেখতে পারবেন না। গুগলের সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
অনেকের দাবি, তারা জানতেন গুগলের সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান রস লাজেউনেস স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছিলেন। তবে বিষয়টি মোটেও সে রকম ছিল না। তারা পরে জেনেছেন যে গুগলকর্মীদের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার ভূমিকার কারণে তাকে গুগল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। যেটা কখনো প্রত্যাশিত ছিল না। গুগলের শুরুর দিকে মুনাফার চেয়ে নৈতিকতার বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হতো। রস লাজেউনেস এমন কিছু বলেছিলেন, যার জন্য তাকে প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য করা হবে, তা তিনি কখনো ভাবেননি। গুগলের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধিই অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি বদলে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
গুগলের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালে এরিক শিমিড যখন সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের কাছ থেকে গুগলের সিইওর দায়িত্ব পান, তখন প্রতিষ্ঠানটির কর্মী সংখ্যা ছিল মোটে তিন শতাধিক। ২০০৪ সালে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার সময়ই গুগলের প্রবৃদ্ধি ১০ গুণ বেড়েছিল এবং এর কর্মী সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। ২০১১ সালে সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ যখন পুনরায় সিইওর দায়িত্বে ফেরেন, তখন আরো ১০ গুণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে গুগল এবং এর কর্মী সংখ্যা ৩২ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
গুগলের সিইও হিসেবে ল্যারি পেজের প্রত্যাবর্তনের চার বছরের কিছু সময় পর গুগলের কার্যক্রমে আরো স্বচ্ছতা আনতে এবং ব্যবসার পরিধি বাড়াতে প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেট গঠন করা হয়। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির কর্মী সংখ্যা ৬১ হাজার ৮১৪-তে পৌঁছেছিল। পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে গুগল এক্স, ফাইবার ও গুগল ভেঞ্চারের মতো ব্যবসা বিভাগগুলোকে গুগল থেকে আলাদা করা হয়। একই সময় ল্যারি পেজ অ্যালফাবেটের সিইওর দায়িত্ব নিলে সুন্দর পিচাইকে গুগলের সিইওর দায়িত্ব দেয়া হয়।
২০১৮ সালে অ্যালফাবেটের কর্মী সংখ্যা ৮৯ হাজারে পৌঁছে। তখন প্রতিষ্ঠানটি জানায়, সিলিকন ভ্যালির বাইরে তাদের প্রবৃদ্ধি বেশি হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নিউইয়র্কে ১৭ লাখ বর্গফুটের নতুন অফিস ও ডাটা সেন্টার চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। এর নিউইয়র্ক অফিসের কর্মী সংখ্যা সাত হাজারে পৌঁছেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন গুগলের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন। প্রতিষ্ঠানটিতে সিইও ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন।
ওই সময় যৌথ বিবৃতিতে ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন জানিয়েছিলেন, অ্যালফাবেটের গুরুত্বপূর্ণ দুই পদ থেকে সরে দাঁড়ালেও পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, শেয়ার অংশীদার ও সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সক্রিয় থাকবেন। জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কাঠামো আরো সহজ করার জন্য তারা দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা জানান, এখন থেকে গুগলের পাশাপাশি অ্যালফাবেটের সিইওর দায়িত্বও পালন করবেন সুন্দর পিচাই। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির কর্মী সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার জনে পৌঁছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় জমা দেয়া নথিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, গুগল ক্লাউড ও সার্চ বিভাগে কর্মী সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
গুগলের সাবেক কর্মীদের ভাষ্যে, বর্ধিত কর্মীদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে না। প্রকৌশল বিভাগের একজন সাবেক পরিচালক জানিয়েছেন, গুগলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অপ্রাসঙ্গিক কিছু সিদ্ধান্তের কারণে তিনি চাকরি ছেড়েছেন।
গত আগস্টে গুগলের এক বিবৃতিতে বলা হয়, অনেক কর্মী জানতে চান, প্রতিষ্ঠানের কী করা উচিত বা উচিত নয়। দেখুন আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো, যে কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে, তা যথাযথভাবে পালন করা। কাজের সময় তার বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে অযথা সময় নষ্ট করা নয়।
গুগলের কমিউনিটি গাইডলাইনে পরিবর্তন আনার আগে এর অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংসের কারণ উল্লেখ করেছিলেন সাবেক সিইও এরিক শিমিড। তার ভাষ্যে, অতীতের চেয়ে এখন বেশি সমালোচিত হচ্ছে গুগল। এর প্রধান কারণ হলো, নীতিভ্রষ্ট প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠানটির স্বীকৃতি দান। তবে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এ ধরনের প্রতিভাকে এড়িয়ে চলারও উপায় নেই। নিজস্ব ব্র্যান্ডের পণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে অনেক নীতিভ্রষ্ট কর্মীকে ধরে রাখতে হয়। এতে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও সুনাম নষ্ট হয়, যা একটি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডমূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।