ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। মার্কিন বিমান হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের অভিজাত কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে সাম্প্রতিক তিক্ততার সূচনা। এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে বদলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আবার অনেকের মতে, এ হত্যার মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র প্রচলিত যুদ্ধে জড়াবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে দেশ দুটি সাইবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অভিযোগের আঙুল উঠেছে তেহরানের দিকে।
কাসেম সোলাইমানি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। শুক্রবার ভোরে ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অভিমুখে সোলাইমানির গাড়িবহরে রকেট হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে এ হামলায় নিহত হন ইরানি এ তারকা জেনারেলসহ কয়েকজন। হত্যাকাণ্ডের ‘কঠোর প্রতিশোধ’ নেয়ার হুমকি দিয়েছে তেহরান। সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও।
সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর শনিবার অফলাইন ও অনলাইন দুই মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রথম আঘাত আসে। বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের কাছে রকেট হামলা হয়। অন্যদিকে মার্কিন মুলুকে কয়েকটি সরকারি ওয়েবসাইটের দখল নিয়ে নেয় হ্যাকাররা। আমেরিকার ফেডারেল ডিপোজিটরি লাইব্রেরি গ্রোগ্রামের ওয়েবসাইটে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিকৃত ছবি যুক্ত করা হয়। এতে দেখা যায়, ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ডের মুষ্ঠি ট্রাম্পের মুখে আঘাত করছে। এতে রক্তাক্ত হয়েছেন ট্রাম্প। নিচে আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় শোষিত জনতার উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন হ্যাকাররা।
মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটিজের সাইবার নিরাপত্তার মুখপাত্র সারা সেনডেক বলেন, সাম্প্রতিক এ সাইবার হামলা ইরান থেকে চালানো হয়েছে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে।
কয়েক বছরে ফেসবুক ও টুইটারে এমন অনেক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে, যেগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়েছে ইরান সরকারের হয়ে এসব অ্যাকাউন্ট নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট করা হতো। এরই মধ্যে এমন অনেক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক ও টুইটার কর্তৃপক্ষ।
সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি ফায়ারআইয়ের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক লি ফস্টার বলেন, কয়েক বছর ধরেই ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অনলাইনে স্পর্শকাতর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে ইরান। অনলাইনে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র নেটওয়ার্ক গড়তে চাইছে দেশটি। এ নেটওয়ার্কের মূল লক্ষ্য হলো ইরানবিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে (বিশেষত মার্কিন) সাইবার আক্রমণ চালানো।
আটলান্টিক কাউন্সিলের ডিজিটাল ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাবের পরিচালক গ্রাহাম ব্রোকি জানান, অনলাইনে ইরানের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কিংবা স্পর্শকাতর কর্মকাণ্ডগুলো সবসময় খুব গোপনে পরিচালিত হয়। সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের আসল পরিচয় বের করা কঠিন। সর্বোচ্চ জানা যাবে, অ্যাকাউন্টটি ইরানের ভেতর নাকি বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে। মূলত এর মধ্য দিয়ে বিদেশনীতি বাস্তবায়ন করতে চায় তেহরান। হঠাৎ করে কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এর আগে আঘাত এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাত, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায়ও।
বর্তমান প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিরোধে একধাপ এগিয়ে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর জের ধরে বিরোধ বাড়লেও প্রচলিত যুদ্ধ শুরু করতে উভয় দেশই দ্বিতীয়বার ভাববে। এর প্রধান কারণ সম্ভাব্য অর্থনৈতিক চাপ। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞায় ইরানি অর্থনীতি আগে থেকেই চাপের মুখে রয়েছে। যুদ্ধ বাধলে দেশটি আরো বড় বিপদে পড়তে পারে। ভালো নেই মার্কিন অর্থনীতিও। এ পরিস্থিতিতে দেশটির কংগ্রেস অভিশংসনের মুখে থাকা ট্রাম্পকে নতুন যুদ্ধের অনুমতি দেবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। তাই প্রকাশ্য যুদ্ধে না জড়ালেও সাইবার জগতে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ আগামী দিনগুলোয় আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে পারে।
সিএনএন, রয়টার্স ও দ্য ইনডিপেনডেন্ট অবলম্বনে