তিন ধরণের মডেল নিয়ে ফ্ল্যাগশিপ নতুন গ্যালাক্সি স্মার্টফোন বাজারে এনেছে স্যামসাং। শীর্ষ গ্যালাক্সি এস২০ নামে নতুন এই স্মার্টফোনটি ফাইভ-জি ব্যবহার উপযোগী এবং এতে রয়েছে ১০০এক্স জুম ক্যামেরা।
নতুন ধরণের ফোল্ডিং সেটও বাজারে আনার কথা নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যাকে বলা হচ্ছে গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ। এই ফোনটির ডিসপ্লে-তে ‘ফোল্ডিং গ্লাস’ বা ভাঁজ করা যায় এমন কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। আর ভাঁজের মাঝখানে ক্ষতি বা ভাঙন এড়াতে সূক্ষ্ম তন্তু ব্যবহার করা হয়েছে।
আসছে কয়েক সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক প্রতিযোগীরা নতুন ফোন বাজারে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ফোনের উৎপাদনে প্রভাব ফেলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
‘ভাইরাসটি সরবরাহ শৃঙ্খল বা সাপ্লাই চেইনে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে,’ বলেন প্রযুক্তি বিষয়ক কনসালটেন্সি সিসিএস ইনসাইটের বেন উড।
‘যদিও স্যামসাং চীনের বাইরেও বিভিন্ন দেশে তাদের উৎপাদনের কারখানাগুলো সরিয়ে নিয়েছে, তবুও এই ফোনগুলোর অনেক যন্ত্রাংশই এখনো চীনে তৈরি হয়।’
নতুন বছরের ছুটির পর দেশটির অনেক কারখানাই খুলতে দেরি করছে কর্মক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে। এছাড়াও চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্মার্টফোন বাজার এবং এই প্রাদুর্ভাব স্থানীয় চাহিদাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে।
এখনো পর্যন্ত প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেকটা কম ক্ষতির মুখে পড়েছে স্যামসাং। কারণ প্রতিষ্ঠানটি তাদের বেশিরভাগ হ্যান্ডসেট তৈরি করে ভিয়েতনামে, এবং চীনের ভোক্তাদের কাছেও তুলনামূলক কম ফোন বিক্রি করে তারা।
কিন্তু ট্রেন্ডফোর্স নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখনো আশঙ্কা করছে যে, ভাইরাসের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রতিষ্ঠানটিতে বছরের চলতি তিনি মাসে অন্তত ৩ শতাংশ কম ফোন উৎপাদিত হবে।
‘আমি এমন আশঙ্কা করছি এটা বোঝাতে যে নতুন হ্যান্ডসেট সরবরাহ করতে এদের কিছুটা দেরি হবে,’ বলেন আইডিসি এর বিশ্লেষক ফ্রান্সিসকো জেরোনিমো।
স্যামসাং বিবিসিকে বলেছে যে তারা ‘উৎপাদনে যাতে সর্বনিম্ন প্রভাব পড়ে তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’
এস২০ এর তিনটি ধরণ রয়েছে:
• বেসিক বা মূল মডেল যার ৬.২ ইঞ্চি (১৫.৭ সেমি) ডিসপ্লে রয়েছে। পেছনে রয়েছে তিনটি ক্যামেরা: এরমধ্যে একটি ৬৪ মেগাপিক্সেলের টেলিফটো লেন্স, একটি ১২এমটি ওয়াইড এবং আরেকটি ১২এমপি আলট্রা-ওয়াইড ক্যামেরা। যার দাম শুরু হবে ৯৯৯ মার্কিন ডলার বা ৭৯৯ পাউন্ড।
• এস২০ প্লাস যার ডিসপ্লে ৬.৭ ইঞ্চি(১৭সেমি)। মূল মডেলের তুলনায় এতে একটি আলাদা সেন্সর রয়েছে। ফোনটির দাম ধরা হয়েছে ১১৯৯ ডলার বা ৯৯৯ পাউন্ড।
• এস২০ আলট্রা যার ডিসপ্লের দৈর্ঘ্য ৬.৯ ইঞ্চি(১৭.৫সেমি)। এর টেলিফটো লেন্সটি যদিও ৪৮এমপি, কিন্তু ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স ১০৮এমপি। এটির দাম ১৩৯৯ ডলার বা ১১৯৯ পাউন্ড।
আলট্রা এস২০ এর ক্যামেরা অন্যদের তুলনায় বেশি উন্নত কারণ এতে একটি পেরিস্কোপ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এটি একটি প্রিজমকে কাজে লাগিয়ে আলো ডিভাইসটির ভেতরে প্রতিফলিত করে, যার কারণে দীর্ঘ লেন্স এবং বড় সেন্সর ব্যবহার করে ওয়াইড-অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা সম্ভব হয়।
যদিও ১০৮ মেগাপিক্সেলে ছবি তোলা সম্ভব তবে ব্যবহারকারীরা বেশিরভাগ সময়েই হয়তো ফোনটিকে অটোমেটিক মুডে ব্যবহার করবেন যেখানে ফোনটি আপনা থেকেই ছবি তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে নয়টি পিক্সেলকে একত্রিত করে একটি পিক্সেল পরিণত করবে।
১০০এক্স ‘সুপার রেজ্যলিউশন জুম’ সুবিধায় ৪৮এমপি ক্যামেরা ব্যবহৃত হবে। যার কারণে একটি সাধারণ জুমের তুলনায় আরো ভাল ফল পেতে ২০টি আলাদা ফ্রেমের পিক্সেল একত্রিত করতে পারবে এটি।
এরফলে হুয়াওয়ের পি৩০ হ্যান্ডসেটের তুলনায় দ্বিগুণ জুম করার সক্ষমতা পেলো স্যামসাং। তবে আসলেই এই সক্ষমতার কতটুকু বাস্তবে ব্যবহার করা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘১০০এক্স জুম দিয়ে তোলা ছবি আপাতদৃষ্টিতে ব্লার বা ঘোলা মনে হবে, তাই আমার মনে হয় না যে মানুষ এটা সব সময় ব্যবহার করবে,’ বলেন জেরোনিমো।
‘কিন্তু দোকানে যখন এটিকে দেখানো হবে তখন এটি ওয়াও ফ্যাক্টর বা বিস্ময়কর বলে মনে হবে। আর ২০এক্স বা ৩০এক্স ব্যবহার করেও খুব ভাল ছবি তোলা সম্ভব।’
এই ফোনে সিঙ্গেল টেক মুড রয়েছে। স্যামসাং বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়েছে যা একই সাথে বিভিন্ন ক্যামেরা ব্যবহার করে স্টিল বা স্থির ছবি তোলা এবং ভিডিও করতে থাকে। তাই ফোনের মালিক ছবি তোলার পর তার ইচ্ছানুযায়ী পছন্দেরটি বেছে নিতে পারবেন।
‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে ব্যবহারকারীরা যাতে তাদের সামনে থাকা মুহূর্তটি পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে…আর এর জন্য যাতে তাদের সেটিংস পরিবর্তন করার দরকার না হয়,’ বলেন প্রোডাক্ট ম্যানেজার মার্ক হলোওয়ে।
এইট-কে রেজ্যলিউশন ধারণ করতে সক্ষম এমন বৈশিষ্ট্যের ফোন এটিই প্রথম। এইট-কে ফোরকে এর তুলনায় চারগুণ এবং ১০৮০ হাই ডেফিনেশনের তুলনায় ১৬ গুন বেশি পিক্সেল ধারণ করে থাকে।
বেশিরভাগ মানুষের কাছে এইট-কে স্ক্রিনই নেই, কিন্তু স্যামসাং বলছে যে এটি দিয়ে ভবিষ্যতের সাথে তাল মেলানোর মতো ছবি তোলা সম্ভব এমনকি ফুটেজ থেকেও উচ্চমান সম্পন্ন ছবি তোলা সম্ভব।
‘স্যামসাংয়ের ক্যামেরা কার্যক্রম যেভাবে তৈরি করা হয়েছে সেটির সাথে নতুন প্রযুক্তি এবং ইউজার ফ্রেন্ডলি বা সহজে ব্যবহারের বিষয়টির মেলবন্ধন থাকা উচিত,’ বলেন ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজিসের কর্মকর্তা ক্যারোলিনা মিলানেসি।
‘অতীতে প্রতিযোগীদের সাথে সমান তালে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি স্যামসাং, কারণ অ্যাপল এবং গুগলের তুলনায় তাদের ফোনের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যবহৃত সফটওয়্যারগুলোর সক্ষমতা তেমন আশাব্যঞ্জক ছিল না বলেই আভাস পাওয়া গেছে। আর এবার তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও যোগ করেছে।’
ফাইভ-জি সংযোজন
স্যামসাংয়ে ফাইভজি সংযোজনের কারণে গেমিং আরো সহজ হবে, ধারণা করা হচ্ছে যে, এর ফলে অনলাইন টাইটেলের যেকোনো ইভেন্টে খেলোয়াড়েরা ফোরজি সংযোগের তুলনায় সেকেন্ডেরও কম সময়ে দেখতে এবং প্রতিক্রিয়া করতে পারবে।
এছাড়া ফোনের গুগল ডুয়ো অ্যাপের ভিডিও চ্যাট আগের তুলনায় ফাইভজি-তে অনেক বেশি উন্নত হবে। ফাইভজি নেটওয়ার্ক এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও পরামর্শকরা বলছেন যে, স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ হিসেবে এই সুবিধাটি এখনই দেয়াটা যুক্তি সম্পন্ন।
‘ভোক্তারা সাধারণত তাদের ফোন তিন থেকে চার বছর ব্যবহার করে থাকে এবং এই সময়ের মধ্যে বাতিল হয়ে যাবে এমন কিছু তারা চায় না,’ বলেন বেন উড।
‘আর এই উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে একটি আলাদা সুযোগও তৈরি হয়েছে: হুয়াওয়ের গুগল অ্যাপে প্রবেশাধিকার না থাকায় তারা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে, আর অ্যাপলের এই মুহূর্তে ফাইভজি ক্ষমতাসম্পন্ন আইফোন নেই।’
ওয়ালেটের আকার
জেড ফ্লিপ এখনো ফোরজি-তেই রয়েছে। এর বেশ কয়েকটি ফিচার- বিশেষ করে ঝিনুকের মতো ডিজাইন যার বাইরের দিকে ছোট একটি ডিসপ্লে এবং ভেতরে ৬.৭ ইঞ্চির ডিসপ্লে সমৃদ্ধ ফোনটি এরইমধ্যে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়েছে।
এর আগেও স্যামসাং ভাঁজ করা যায় এমন একটি হাইব্রিড গ্যালাক্সি ট্যাবলেট ফোন বাজারে এনেছিল যেটিতে ত্রুটি দেখা দেয়।
এবার তাদের বাজারে আনা ফোনটি লম্বা স্ক্রিনযুক্ত যা খোলা থাকা অবস্থায় এক হাতে ব্যবহার করা যায় এবং ভাঁজ করে বন্ধ করলে ওয়ালেটের আকার হয়।
ভাঁজ করার প্রযুক্তিও উন্নত হয়েছে। এতে এখন ছোট একটি ব্রাশ রয়েছে যা ময়লা এবং ধুলার মতো উপাদান সরিয়ে ফেলে। একই সাথে, এটা ফোনটিকে আংশিক খুলে রাখতে পারে, যা শ্মশানয়ের মতে সেলফি তোলা বা ভ্লগ রেকর্ডিংয়ে ব্যবহারকারীদের সাহায্য করতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এটি ২ লাখেরও বেশি বার খোলা এবং বন্ধ করা যাবে।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ডিসপ্লে, যেখানে এখন একটি উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে যাকে স্যামসাং বলছে ‘ফোল্ডিং গ্লাস’।
‘আপনি হয়তো খেয়াল করবেন যে, স্ক্রিনটি ফোল্ডের তুলনায় বেশি প্রতিরোধী, যার কারণে এতে আঁচর পড়ার সম্ভাবনা কম,’ বলেন ফ্রান্সিসকো।
‘এটা হয়তো স্বাভাবিক স্মার্টফোনের মতো এতো বেশি প্রতিরোধী নয় কিন্তু আপনি এর মান বুঝতে পারবেন।’
জেড ফ্লিপের দাম পড়বে যুক্তরাষ্ট্রে ১৩৮০ ডলার এবং যুক্তরাজ্যে ১৩০০ পাউন্ড। যা পাওয়া যাবে ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে।
এটি একই রকম ডিজাইনের মটোরোলার রেজর এর সাথে প্রতিযোগিতা করবে। তবে এই দুটি সেটই এস২০ এর তুলনায় অনেক কম বিক্রি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘নতুন এই ফোনটি নিয়ে অনেক উত্তেজনা আছে, কিন্তু বেশিরভাগের জন্যই এগুলো খুব বেশি দামী,’ বলেন পিপি ফোরসাইটের পাওলো পেসকাটোর।
সূত্র: বিবিসি বাংলা