করোনাভাইরাস বাস্তবতায় পাল্টে গিয়েছে আমাদের দৈনন্দিন চালচিত্র। সবকিছু যতদূর সম্ভব উঠেছে অনলাইন নির্ভর। বাজার করা থেকে শুরু করে অফিসের কাজ, পড়ালেখা, বিনোদন, যোগাযোগ সব কিছুতেই আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে নানাবিধ ডিজিটাল ডিভাইসের উপর।
যোগাযোগ আর বিনোদনও পুরোপুরি চলে গেছে অনলাইনে। একদিকে হয়তো এতে আমাদের লাভই হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদে নিজেদের দরকারি কাজগুলো সারতে পারছি আমরা। তবে, এর নেতিবাচক দিকটিও কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। প্রতিদিন বেশ লম্বা একটা সময় ডিজিটাল পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে আমাদের চোখ, বিশেষ করে শিশুদের চোখ।
অন্যান্য বিষয়ের মতো এ ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আর সতর্কতার প্রথম ধাপ হচ্ছে, সমস্যা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া।
জেনে নেওয়া যাক লম্বা সময় পর্দার দিকে তাকিয়ে কাটানোর ফলে ঠিক কী ধরনের সমস্যায় পড়তে পারি আমরা এবং সমস্যার প্রতিকারে কী করা উচিত আমাদের-
আক্রান্ত হতে পারেন ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমে’
দীর্ঘসময় পর্দার সামনে বসার পর আপনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে? ঘাড়ে ব্যথা থাকে? মাথা ব্যথা করে? চোখ শুকিয়ে যায়? যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি সম্ভবত এরই মধ্যে ভূগতে শুরু করেছেন ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমে’। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিল এ সমস্যাটির কথা।
প্রতিদিন তিন ঘণ্টার বেশি পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলে এ সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক গবেষকই এ সমস্যাটিকে “একুশ শতকের এক নম্বর কাজের বিড়ম্বনা” – হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দীর্ঘসময় পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা, পর্দা চোখের খুব কাছে থাকা, এমন সব কারণে হয়ে থাকে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম। অনেকের ক্ষেত্রে হালকা বিশ্রামে ভালো হয়ে গেলেও, অনেকের আবার পুরো একটি দিন-ও লাগে চোখ এবং শরীরকে এ ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বের করে আসতে।
চোখের নিঃসরণে আসতে পারে পরিবর্তন
লম্বা সময় পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের নিঃসরণে আসতে পারে পরিবর্তন। অন্তত সেরকম তথ্যই উঠে এসেছিল ২০১৪ সালে জাপানে হওয়া এক গবেষণায়।
প্রধান গবেষক এবং কিয়োটো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ইউচি উচিনো বলছেন, চোখের উপরিভাগের পাতার নিঃসরিত এমইউসি৫এসি নিঃসরণ চোখের আর্দ্রতায় ভূমিকা রাখে। লম্বা সময় পর্দার দিকে তাকিয়ে যাদের কাজ করতে হয়, তাদের চোখের ওই নিঃসরণটিতে পরিবর্তন ধরা পড়ছে। তাদের চোখ শুকনো থাকছে।
এর কারণ হিসেবে ড. উচিনো বলছেন, আমরা যখন ডিজিটাল পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকি তখন আমাদের চোখ পলক ফেলতে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সময় নেয়।
“শুধু তাই নয়, আমরা পর্দার দিকে যখন তাকাই তখন স্বাভাবিকের চেয়ে চোখ বড় করে তাকাই, ফলে চোখের উপরিভাগটির বড় অংশ খোলা থাকে এবং বাতাসের সংস্পর্শে শুকিয়ে যেতে থাকে।”
তিনি বলেন, লাখ লাখ লোক প্রতি বছর শুষ্ক চোখের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন এবং এদের বড় অংশই দীর্ঘ সময় কম্পিউটারে কাজ করেন।
প্রভাব পড়তে পারে রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষে
ডিভাইসের পর্দা থেকে যে নীলচে আলো বিচ্ছুরিত হয় তা একেবারেই কৃত্রিম এবং এই আলোর জন্য চোখ প্রাকৃতিকভাবেই প্রস্তুত নয়। ফলে, এই আলোতে পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য চোখের পক্ষে ফোকাস করা কঠিন। সেই চাপ গিয়ে পড়ে চোখের রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলোয়। অবশ্য চিকিৎসকদের মধ্যে এ নিয়ে ভিন্ন মতও আছে।
সমস্যার সমাধানে যা করা যেতে পারে-
এই সমস্যা নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তাক আহাম্মদের সঙ্গে। “আমাদের চোখ কিন্তু সবসময়ই পানি নিঃসরণ করে, যেটি চোখের উপরিভাগকে আর্দ্র রাখে বা ভিজিয়ে রাখে। সেইসঙ্গে চোখের পানি বা অশ্রু কিন্তু কিছু ব্যাকটেরিয়ার বেলায় প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। ফলে চোখ যদি শুকিয়ে যায় তাহলে চোখের সেই রক্ষাকবচটি থাকে না।”
ডা. মোস্তাক আহাম্মদ বললেন, মূল কথা হচ্ছে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন চোখ শুকিয়ে না যায়। যেহেতু মনিটরের দিকে তাকালে চোখ শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তাই প্রথম উপায় হিসেবে প্রয়োজন ছাড়া পিসি, ডেস্কটপ, ট্যাবলেট বা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে হবে। “যদি দীর্ঘ সময় কাজ করতেই হয়, তহলে পালন করতে হবে ২০-২০-২০ পদ্ধতি।”
কী সেই ২০-২০-২০ পদ্ধতি?
প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য চোখ পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে ২০ ফিট দূরত্বের কোনো জিনিসে তাকিয়ে থাকতে হবে। এতে করে চোখ খানিকটা রেহাই পাবে। চোখকে রেহাই দেওয়ার জন্য এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি। পাশাপশি প্রতি এক ঘণ্টা কাজ করার পর অন্তত ১০ মিনিট বিরতি নেওয়ার কথাও বললেন ডা. মোস্তাক আহাম্মদ।
কিবোর্ডের সঙ্গে বোঝাপড়া
চোখের পলক ফেলার জন্য ভিন্ন এক পদ্ধতির কথা বললেন তরুণ চিকিৎসক ডা. ওয়াসেক বিন শহীদ। তিনি আপনার কিবোর্ডের সঙ্গে বোঝাপড়ার কথা বললেন। “যদি আপনার পিসিতে বা ল্যাপটপে দীর্ঘক্ষণ টাইপ করতে হয় তবে কিবোর্ডের একটি কি ঠিক করে নিন। এটি হতে পারে স্পেস বার, বা কোনো অক্ষর। যখনই ওই বিশেষ কি চাপবেন আপনি চোখের পলক ফেলার অভ্যাস করবেন।” এতে করে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকায় পলক ফেলা কমে যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন আপনি। “প্রথম দিকে হয়তো ভুল হয়ে যাবে, পলক ফেলতে মনে থাকবে না। কিন্তু একবার অভ্যাস হয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে আপনাকে সাহায্য করবে এই অভ্যাস।”- বললেন ডা. শহীদ।
ব্যবহার করতে পারেন ‘অ্যান্টি গ্লেয়ার ফিল্টার’
অ্যান্টি গ্লেয়ার ফিল্টার ব্যবহার করে চোখে আরাম পাওয়া সম্ভব। চাইলে যেকোনো ফ্ল্যাট পর্দার জন্য এটি ব্যবহার করতে পারেন।
নিয়ন্ত্রণে রাখুন আলো
আপনি যেখানে বসে কাজ করছেন, সে স্থানের আলো এবং আপনার ডিজিটাল ডিভাইসের পর্দার আলোর পার্থক্য বিচার করুন। চোখের উপর চাপ পড়ছে কিনা তা খেয়ালে রাখুন। চাপ কম পড়বে এমনভাবে আলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন।
পর্দা থাকুক দূরে
চেষ্টা করুন পর্দাকে সরাসরি চোখ বরাবর না রেখে ১৫-২০ ডিগ্রি বা ১০-১৩ সেন্টিমিটার নিচে রাখতে। ফলে একদিকে যেমন আপনার দেখতে সুবিধা হবে, তেমনি অন্যদিকে আরাম পাবেন চোখে। সবসময় খেয়াল রাখবেন ডিজিটাল ডিভাইসের পর্দা যাতে আপনার মুখমণ্ডল থেকে ১৮-২৬ ইঞ্চি বা ৪৬-৬৬ সেন্টিমিটার দূরে থাকে। মনে রাখবেন, এতটুকু দূরত্ব না থাকলে চাপ পড়বে চোখে।
সমস্যায় প্রখম আশ্রয় চিকিৎসক
সাধারণভাবে প্রতি এক বা দুই বছরে একবার অন্তত চোখের সাধারণ চেকআপ করিয়ে নেওয়া উচিৎ। তবে, পর্দার দিকে তাকানো হোক বা অন্য যে কোনো কারণে দৃষ্টিক্ষমতা বা চোখ বিষয়ক অন্য কোনো সমস্যায় দ্রুত চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। এবং আরও জরুরী সেই চিকিৎসক যেন অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হন সেটি নিশ্চিত হয়ে নেওয়া।