স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদনে দেওয়া কর অব্যাহতির সুবিধা আরো সংকোচনের কথা ভাবছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্বের কর্মকর্তারা মনে করছেন, বছরের পর বছর ধরে কর সুবিধা পেয়ে এসব শিল্প নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
এনবিআরের সূত্রগুলো জানায়, চলতি অর্থবছরে এসব খাতের উপর আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে নতুন করে আরো আড়াই থেকে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো হতে পারে।
রাজস্ব বোর্ডের কর সুবিধা (কর অব্যাহতি, বা ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য কম কর হার) পুনর্বিবেচনা করাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো দক্ষ হতে উৎসাহিত করবে। তবে উদ্যোক্তাদের শঙ্কা, এতে উদীয়মান স্থানীয় প্রস্তুতকারক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এসব শিল্পের অব্যাহত বিকাশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটাই তাঁদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, “আমরা এখনও প্ল্যানিং স্টেজে আছি, কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে, আবার শিল্পও ক্ষতির মুখে পড়বে না– তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম গত দুই মাস মাস ধরে প্রাক-বাজেট সভাগুলোয় একাধিকবার একই রকম পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, “যেসব শিল্প নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে, সেগুলোর উপর থেকে ধীরে ধীরে সাপোর্ট (কর অব্যাহতি) কমাতে হবে।”
এর অর্থ হলো, ওইসব শিল্পের কর, ভ্যাট বা আমদানি পর্যায়ে ট্যাক্স আরোপ করা হবে কিংবা বিদ্যমান ভ্যাট – ট্যাক্স বাড়ানো হবে। এক দশক আগেও বাংলাদেশে ব্যবহার হওয়া মোবাইল ফোনের প্রায় পুরোটাই আমদানি-নির্ভর ছিলো। খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে চাহিদার ৯৫ শতাংশের বেশি স্থানীয় উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে।
বর্তমানে ১২টির বেশি কোম্পানি বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রস্তুতে জড়িত। স্যামসাং, নোকিয়া, ভিভো, শাওমি এবং অপোর মতো শীর্ষ মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারকরা বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে।
দুই বছর আগেও আমদানিকৃত মোবাইল ফোনের উপর টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স (টিটিআই) ছিল ৫৬ শতাংশ, আর স্থানীয় উৎপাদনকারীদের উপর সব মিলিয়ে টিটিআই ছিল ১৫ শতাংশের মত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথমে বিক্রয় পর্যায়ে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বা মূসক আরোপ করা হয়।
বর্তমানে স্থানীয় মূল্য সংযোজন সক্ষমতা বিবেচনায়– মোবাইল ফোন উৎপাদনে ২ থেকে ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিতে হয় উৎপাদন পর্যায়ে। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, আগামী বাজেটে এই ভ্যাট সর্বোচ্চ আরো ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।
একইভাবে এনবিআরের নীতি সমর্থনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ফ্রিজ, এসি, মোটরবাইক, লুব্রিকেন্ট অয়েলসহ বেশকিছু শিল্প গড়ে উঠেছে, যা এসব পণ্যের আমদানি-নির্ভরতা কমাতে সক্ষম হয়েছে। এসব খাতের কোনো কোনোটির উপর থেকেও কর সুবিধা কমিয়ে আনার তথা কর বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।
এছাড়া গত বছর টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, হাইজেনিক টয়লেট সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের হোম অ্যাপ্লায়েন্স এর উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এবার তা আরো বাড়ানোর চিন্তা করছে এনবিআর।
অন্য যেসব খাতে ‘কর বাড়ানো’ হতে পারে
আরো যেসব খাতে ভ্যাট বাড়ানোর চিন্তা চলছে, ওই তালিকায় রয়েছে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বিভিন্ন ধরনের হোম অ্যাপ্লায়েন্স, স্যানিটারিওয়্যার, সানগ্লাস, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়্যাল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়েল, পেপার টাওয়েল, ক্লিনিক্যাল বেডশিট ইত্যাদি। এ তালিকায় যুক্ত হতে পারে প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্রও। এছাড়া যেসব শিল্প আমদানিতে কম কর হারের সুবিধা পায়, ওই সুবিধাও কমানোর চিন্তা করা হচেছ বলে এনবিআরের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এখন তথ্য সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ করছি। অব্যাহতি সুবিধা কমানোর পর তা সেক্টর, দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে কী ধরনের প্রভাব রাখবে – তা বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।”
সূত্রগুলো জানায়, এনবিআরের কর বিভাগ ছাড়াও ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগও কর অব্যাহতি বিশ্লেষণ করছে। বাজেটের আগেই এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পরবর্তী অর্থবছরের কর অব্যাহতি কী হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ মুঠোফোন প্রস্তুতকারক– ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. মেসবাহ উদ্দিন বলেন, “ইতিমধ্যে ভ্যাট আরোপের কারণে আমরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। ২০২৩ সালে মোবাইল ফোন বিক্রি ৩৫ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরও এটি কমতির দিকে। এমনভাবে পলিসি করা হোক, যাতে ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকে।”
তবে এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. লুৎফর রহমান বলেন, “অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আমি এটিকে স্বাগতই জানাব। যেসব কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার একটা ইমপ্যাক্ট এনালাইসিস করা দরকার, তাহলে জানা যাবে এই সুবিধার কতটুকু ভোক্তার কাছে গেছে, আর কতটুকু কোম্পানির পকেটে গেছে।”
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “অনির্দিষ্টকাল ধরে ট্যাক্স এক্সেম্পশন সুবিধা চলতে পারে না। এসব সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে– তা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে। এতে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।”
তিনি বলেন, “শুধু ভ্যাট নয়, করের ক্ষেত্রেও অব্যাহতির সুবিধা আর বাড়ানো উচিত হবে না। আমদানির ক্ষেত্রেও যে ট্যারিফ সুরক্ষা দেওয়া আছে, তা কমানো উচিত।” ‘টিবিএস’