মিনিটখানেকের বিজ্ঞাপনের চমকের মোড়কে যা দেখা যায়, তার অনেক গুণ তথ্য যেমন ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনন্ড অ্যাপ্লায়েড’-এর ফাইন প্রিন্টসে লুকিয়ে থাকে, তেমনই মোবাইল ক্যামেরার প্রতি বিশেষ দূর্বলতা থাকা গ্রাহকদেরও ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই কোনও মোবাইলে ৪৮ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা আছে মানেই সেটা কিনে ফেললে দুরন্ত সব ছবি তোলা যাবে। এই ফাঁদে পা না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
২০০৯-২০১০ সালের দিকে যখন নকিয়া ফোনে ০.৩ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা ব্যবহার করত তথন কিছু চাইনিজ কোম্পানি তাদের ফোন ব্যবহার করত ৬ থেকে ৮ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা । তবে তাদের ফোনের তোলা ছবির পার্থক্য তো আমাদের সবার জানা ।
তাই সবার আগে মনে রাখা দরকার, বর্তমানে স্মার্টফোনের ক্যামেরা একটি অত্যন্ত জটিল এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির গ্যাজেট, যা ভালো মানের কি না জানতে হলে, তার পিছনের সর্বাধুনিক অপারেটিং প্রযুক্তি এবং ক্যামেরায় ছবি তোলার প্রযুক্তির খুঁটিনাটি হয় আপনাকেই বুঝতে হবে। আর না হলে, যাঁরা বোঝেন, তাদের থেকে বিষয়টি বুঝে নিয়ে, তবেই সেই ‘ক্যামেরা’ওলা ফোন কেনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে।
শুরুর থেকে শুরু করার আগে, এক মিনিট চিন্তা করে নিন, ৪৯ হাজারের ওয়ানপ্লাস ৭ প্রো বা ৩৮ হাজারি ‘অনর ভিউ২০’, ৩২ হাজারের (সম্ভাব্য) ‘আসুস জেনফোন ৬’ থেকে ২৮ হাজারের ‘ভিভো ভি১৫ প্রো’ বা ৩৯ হাজারের ‘অপাে এফ১১ প্রো’ মায় ১৮ হাজারি ‘শাওমি রেডমি নোট ৭’- সবাই কী ভাবে তাদের স্মার্টফোনের দামের এ হেন তফাৎ সত্ত্বেও ৪৮ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা দিতে পারেন। তাহলে কি মেগাপিক্সেল ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়? এ বার কিন্তু সঠিক পথে ভাবতে শুরু করেছেন আপনি।
সোজা কথায় বললে, বেশি মেগাপিক্সেলই নয়, মোবাইল ক্যামেরার কার্যকারিতা নির্ভর করে চারটি স্তম্ভের উপর-সেন্সর, অ্যাপারচার, লেন্স এবং মেগাপিক্সেল কাউন্ট। কে প্রথম, কে দ্বিতীয় তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। তবে এই চারমূর্তির মধ্যে সবথেকে দুর্বল বৈশিষ্ট্য যে মেগাপিক্সেল, তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স বা ন্যানো টেকনোলজি বুঝতে হবে না। এর সঙ্গেই রাখতে হবে মোবাইল ক্যামেরার জন্য বরাদ্দ অপারেটিং প্রযুক্তির উপর। হাল আমলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অপটিক্যাল ইমেজ স্টেবিলাইজেশন, টেট্রাসেল টেকনোলজি বা অত্যাধুনিক অ্যালগরিদমের ‘বলে’ বলীয়ান ক্যামেরার সঙ্গে পুরোনো দিনের প্রযুক্তি দেওয়া একই বৈশিষ্ট্যের ক্যামেরা কখনওই পাল্লা টানতে পারবে না।
এর মধ্যে সেন্সর হল সেই উপাদান, যে কোনও ক্যামেরায় ভালো ছবি তোলার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা বাকি সবার থেকে বেশি হলেও, তাকে নিয়ে আলোচনা ততটাই কম করা হয়। সেন্সরের কাজ হল ছবির আলো ক্যামেরায় ঢোকার পর তাকে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে পরিবর্তিত করা, যা পরবর্তী কালে যা ইমেজ সিগন্যাল প্রসেসরের সাহায্যে পিক্সেলে পরিণত হয়। এই পিক্সেল জুড়েই হয় ছবি। তাই ‘থাম্ব রুল’ ধরা যেতে পারে, যত বড় সেন্সর এবং যত ছোট ‘ক্রপ ফ্যাক্টর’, তত ভালো ক্যামেরা। মোবাইলে সেন্সরের আয়তন বড় করার খুব বড় করার সুযোগ না থাকায়, মোবাইল সংস্থাগুলি এখন ব্যাক ক্যামেরায় একই সঙ্গে দুই বা ততোধিক সেন্সরকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে জুড়ে কাজে লাগাচ্ছে। ফলে ‘ভালো’ মানের সেন্সর না থাকলে মেগাপিক্সেল বাড়ালেও ছবি কিন্তু প্রত্যাশিত মানের হবে না। তবে প্রায় কোনও মোবাইলেই সেন্সরের পরিমাপ উল্লেখ না থাকায়, এটা যাচাই করতে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতেই হবে। সাধারণ ভাবে বর্তমানে সব দামী ফোনেই হয় সোনির আইএমএক্স৫৮৬ না হলে স্যামসাং-এর আইসোসেল ব্রাইট, ব্রিটেসেল সেন্সর ব্যবহার করা হয়।
এর পরে আসছে অ্যাপারচার। মোবাইলের বিজ্ঞাপনে মেগাপিক্সেল-এর পরিমাপের সঙ্গে এফ/১.৮, এফ/১.৮ জাতীয় যে সব বৈশিষ্ট্য লেখা থাকে, তা হল ওই ক্যামেরার অ্যাপারচারের পরিমাপ। এখন এই ‘এফ’-এর পরের সংখ্যা যত ছোট (এফ/২.৮ এর থেকে এফ/১.৮), তত বেশি আলো ক্যামেরার সেন্সরে পড়তে পারে, ফলে ছবির ক্ল্যারিটিও তত ভালো হয়। আলোই কম ঢুকলে তো শুধু মেগাপিক্সেল বেশি বলে ক্যামেরা সেই ছবিকে উন্নত করতে পারবে না। তাই ৪৮ এর বদলে ২৪ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা দেওয়া ফোনও নিতে পারেন, যদি তার অ্যাপারচার এফ/৮ এর বদলে এফ/২.৮ হয়। অ্যাপারচার বড় হলে ফিক্সড লেন্স ক্যামেরায় ডিএসএলআর-এর মতো শাটার স্পিড বা আইএসও অ্যাডজাস্টের চিন্তাও থাকে না। মেগাপিক্সেল তখনই বেশি দরকার লাগবে, যখন সেই ছবি অনেক বড় করে প্রিন্ট করার দরকার পড়বে।
মেগাপিক্সেল ছাড়া তাহলে মোবাইল ক্যামেরা ভালো হওয়ার জন্য আর যা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতেই হবে, তা হল লেন্স। ধরুন আপনার হাতে বোল্ট অ্যাকশন ০.৩০৩ ডবল ব্যারেল গাদা বন্দুক আছে আর আপনার প্রতিপক্ষের হাতে কালাশনিকভ। সেই যুদ্ধে আপনি যত দক্ষ শ্যুটারই হোন না কেন, যেমন জিততে পারবেন না। তেমনই লেন্স ভালো মানের না হলে বাকি মেগাপিক্সেল ৪৮ এর জায়গায় ৯৬ করে দিলেও গোড়ায় গলদ থেকেই যাচ্ছে। কার্ল জেইস, লেইকা বা ক্যাননের মতো নামী ব্র্যান্ডের লেন্স থাকলে ক্যামেরার ভিত মজবুত হতে বাধ্য।
আর ‘নট বাট নট দ্য লিস্ট’, আধুনিক স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলার পর তা যেহেতু একাধিক ডিজিটাল ফিল্টার এবং কনভার্শন-এর মধ্যে দিয়ে যায়, তাই সবকিছুর পরেও মোবাইলে ব্যবহৃত ইমেজ প্রসেসিং বা ডিজিটাল ইমেজ স্টেবিলাইজেশন, পিক্সেল বিন্নিং এর মতো প্রযুক্তিও ভালো ছবি তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
ফলে এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, শুধু মেগাপিক্সেল এর বলে বলীয়ান হয়ে ক্যামেরা ‘যুদ্ধ’ জয় সম্ভব নয়। তাই পরের মোবাইল ক্যামেরা বাছার আগে পকেট বুঝে নজর দিন একটু বাকি বৈশিষ্ট্যগুলিতেও। তাহলেই কেল্লা ফতে হওয়া সম্ভব বাস্তবে।