২০২১ সালজুড়ে দেশের ই-কমার্স খাতে ছিল চরম অস্থিরতা। এখন অস্থিরতা কিছুটা কমে এলেও প্রতারণার শিকার হওয়া অনেকেই জমা দেওয়া ও বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাননি। ই-কমার্স খাতের অস্থিরতার সুযোগে ‘নগদ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুকের নজর পড়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জ শপের ‘নগদ’ একাউন্টে থাকা ১৩৪ কোটি টাকায়।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারণে সৃষ্ট ই-কমার্স খাতের দুর্বলতার সুযোগে ‘সিরাজগঞ্জ শপ’ এর ঐ ১৩৪ কোটি টাকা হাতানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন নগদ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক। একাজে সিরাজগঞ্জ শপ’ এর প্রতিষ্ঠাতা জুয়েল রানা সহযোগিতা না করলে তাকে তুলে আনতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সহ রাষ্টের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেন তিনি। এর ক্রসফায়ার ও গুম করার ভয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টাও করেন নগদ এর এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই হেফাজত থেকে কোন মতে পালিয়ে যান তরুণ উদ্যোক্তা জুয়েল রানা। প্রায় ৩ বছর পরিবার পরিজন ও প্রতিষ্ঠান ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে নিরুদ্দেশ রয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা জুয়েল রানা।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জ শপ প্রায় ৬ লাখ নিবন্ধিত গ্রাহক নিয়ে বন্ধ হওয়ার সময় নগদে প্রতিষ্ঠানটির মার্চেন্ট একাউন্টে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের রহমতগঞ্জে প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থেকে জুয়েল রানাকে তুলে আনা হয় ঢাকার বনানীতে অবস্থিত নগদের প্রধান কার্যালয়ে। প্রস্তাব দেওয়া হয়, সিরাজগঞ্জ শপের নগদ একাউন্টে থাকা ১৩৪ কোটি টাকা তানভীর এ মিশুককে দিতে সহায়তা করলে ৩০ কোটি টাকা পাবেন জুয়েল। সাথে পাবেন নতুন পরিচয়ের পাসপোর্ট, পাঠিয়ে দেওয়া হবে বিদেশে। সহযোগিতা না করলে ক্রসফায়ার অথবা গুম করার ভয় দেখানো হয়। সিদ্ধান্ত নিতে চিন্তাভাবনা এবং গ্রাহকদের বোঝানোর অজুহাতে কৌশলে ৩ দিন সময় নিয়ে সে সময় নগদ কার্যালয় থেকে ছাড়া পান তিনি। সিরাজগঞ্জ ফিরেই প্রায় ১৮ হাজার গ্রাহকের প্রায় ৫৭ হাজারের ইনভয়েসের বিপরীতে অর্থ নগদে রিফান্ড করেন জুয়েল রানা। এতে প্রায় ১২৩ কোটি টাকা সফলভাবে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে একসাথে ১৮ হাজার একাউন্ট ব্লক করে নগদ। বিষয়টি সেসময় দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল। যদিও নেপথ্যের আসল কারণ জানা গেল সম্প্রতি।
দ্বিতীয় বার র্যাব-২ এর কর্মকর্তা দিয়ে তুলে আনা হলেও, তখন পর্যন্ত জুয়েলের বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিল না। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ থেকে জুয়েলকে প্রথমে ঢাকার একটি হোটেলে রাখা হয়। এরপর বনানির নগদ কার্যালয়ে নিয়ে ব্যাপক মানসিক অত্যাচার করা হয় জুয়েলের ওপর। একপর্যায়ে ৪৭ কোটি টাকার একটি ‘একাউন্টস পে’ চেকে এবং প্রায় তিন শতাধিক ডকুমেন্টে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে আবার হোটেলে রাখা হয়। এই চেকের সূত্র ধরে বনানী থানায় তার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে বুঝতে পেরে কৌশলে হোটেল ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমান জুয়েল। সেই থেকে এখনও আত্মগোপনে রয়েছেন জুয়েল। আত্মগোপনে থাকা জুয়েল জানান, তার আশঙ্কা ছিল মামলায় রিমান্ডে নিয়ে নগদে সিরাজগঞ্জ শপের অবশিষ্ট প্রায় ১১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন মিশুক।
এদিকে আরও একটি প্রতারণা করেছে নগদের এমডি মিশুক। ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জ শপের নগদ একাউন্ট থেকে ৮ কোটি ১৮ লাখ ২ হাজার ২৪১ টাকা ‘রিফান্ড’ দেখিয়ে উত্তোলন করার নামে আত্মসাৎ করা হয়। কেননা ওই অর্থ ‘রিফান্ড’ দেখানোর পর সিরাজগঞ্জ শপের ব্যাংক একাউন্টে যাওয়ার কথা থাকলেও, অদ্যবধি সেটি যায়নি।
জুয়েল বলেন, ছয় শতাধিক গ্রাহক প্রায় ৪ হাজার ৭০০ ইনভয়েসের বিপরীতে এই অর্থ নগদের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ শপে পেমেন্ট করেছিলেন যা গ্রাহকদের অর্থ। নিয়ম অনুযায়ী, আরটিজিএস এর মাধ্যমে টাকা সিরাজগঞ্জ শপের ব্যাংক একাউন্টে যাওয়ার কথা, যেটি আজ অবধি যায়নি। আমার প্রশ্ন, তাহলে এই টাকা কোথায়? আর ৪ সেপ্টেম্বর ছিল শনিবার। শনিবার লেনদেন হয় কীভাবে? আমরা তো কোন লেনদেন করতে পারি না শনিবারে! নগদ বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের একাউন্ট থেকেও গ্রাহকের অনুমতি ছাড়াই অর্থ সরিয়েছে বলেও অভিযোগ জুয়েলের। নগদের এক গ্রাহকের একাউন্টের লেনদেন থেকে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
জুয়েল রানা জানান, এই অর্থের পুরোটাই ভুক্তভোগী ই-কমার্স গ্রাহকদের টাকা, বাকিটা তার নিজের ব্যবসার। পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকার অর্থের একটি হিসেব জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসেব অনুযায়ী, নগদে সিরাজগঞ্জ শপের আটকে রয়েছে মাত্র ১ পয়সা। তাহলে সিরাজগঞ্জ শপের ৮ কোটি সহ বাকি টাকা কোথায়? এর থেকেও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, নগদে সিরাজগঞ্জ শপের কোন টাকা না থাকলেও শর্ত সাপেক্ষে জুয়েলকে টাকা দিতে রাজি হয়েছে নগদ। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিজের এবং গ্রাহকদের প্রাপ্য অর্থ ফিরিয়ে দিতে দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন জুয়েল। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের নিয়ে নগদ কার্যালয় ঘেরাও করার পরামর্শ দিলে জুয়েলের সাথে যোগাযোগ করে নগদের একজন প্রতিনিধি। পাশাপাশি আরেক বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের প্রধান নির্বাহী রিপন মিয়া জুয়েলকে জানান, গ্রাহকদের পণ্য ডেলিভারির প্রমাণ এবং লেনদেনের বিবরণ দিলে সেই ৮ কোটি টাকা জুয়েলকে ফিরিয়ে দিবে নগদ।
বনানী থানাতে জুয়েলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে নগদ মামলার (নং২৪(৯)২১) করে। মামলার তদন্তভার যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এস আই) এস এম মাসুদ করিম এর কাছে। । চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ১৮ হাজার একাউন্টে এবং সুনির্দিষ্ট ৮টি একাউন্টে সিরাজগঞ্জ শপের অস্বাভাবিক লেনদেনের পেছনে অর্থ পাচারের যে সন্দেহ নগদের ছিল, সেটি ঠিক নয়। বিষয়টি নগদ তার নিজস্ব অনুসন্ধানেও দেখতে পায় বিধায়, একাউন্টগুলো পরবর্তীতে ধাপে ধাপে সচল করা হয়। এদিকে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর সিআইডি’র অতিরিক্ত আইজিপি বরাবর এক চিঠিতে নগদ মামলাটি আর পরিচালনা করবে বলেও জানায়। এমন অবস্থায় জুয়েলকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি।
তানভীর মিশুকের ষড়যন্ত্রে জুয়েলের পাশাপাশি হয়রানির শিকার হয়েছেন তার নিকট স্বজনরাও, যাদের মধ্যে সেসময় অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন এমন নারী ও পুরুষ আত্মীয় ছিলেন। আমার খোঁজ পেতে বাসায় যায়, না পেয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকদের মাধ্যমে মাদক দিয়ে আমার ঘনিষ্ঠ জনদের ফাঁসানোর চেষ্টা করে। সেসময়ের হিসেবে বড় ভাই আনোয়ার হোসেন (৪০), ছোট ভাই ইউসুফ আলী (১৬), মামাতো বোন (১৪) ও মামী এবং সহযোগী শামীমকে আটক করে তারা। এদের মধ্যে আনোয়ার, ইউসুফ এবং শামীমকে প্রথমে সিরাজগঞ্জ র্যাবে এবং পরে ঢাকায় র্যাব-২ এ আনা হয়। বাকিদের সিরাজগঞ্জেই কোন মামলা ছাড়াই আটকে রাখে। বিদেশ চলে এসেছি এবং আটককৃতদের সাথে কোন যোগাযোগ আমার নেই, এটা নিশ্চিত হলে ৯ সেপ্টেম্বর তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জুয়েল বলেন, আমাকে হয়রানি করতে এবং চাপ দিয়ে বাকি অর্থ হাতিয়ে নিতেই মামলা করেছিল নগদ। ৩০ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে আরামে কাঁটাতে পারতাম, কিন্তু বিবেক সায় দেয়নি। নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছি। আর তার খেসারতে আমি নিজের জীবন থেকে পলাতক। প্রকাশ্যে আসতে পারি না, আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করতে পারি না। তারা অনেক প্রভাবশালী। নতুন স্বাধীন দেশে প্রত্যাশা যে আমার সাথে ন্যায় বিচার হবে আর গ্রাহকরা তাদের টাকা পাবে।
এ বিষয়ে নগদের সাথে যোগাযোগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত নগদের পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য আসেনি।