প্রযুক্তি বিশ্ব যখন চীনের ডিপসিক এআই মডেলে আচ্ছন্ন তখন আরেক শীর্ষ চীনা প্রতিষ্ঠান আলিবাবা নিয়ে এসেছে নতুন এআই মডেল ‘কোয়েন ২.৫-ম্যাক্স’। আজ (বুধবার) চীনা নববর্ষের ছুটির দিনেই আলিবাবা তাঁদের ‘কোয়েন ২.৫’ এআই মডেলের সাম্প্রতিক এই ভার্সনটি রিলিজ করেছে। সক্ষমতার দিক দিয়ে নতুন মডেলটি ডিপসিকের উন্নত ভি৩ (ভিথ্রি) এআই মডেলকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি এশিয়ার এই টেক জায়ান্টের।
চীনা নববর্ষ উপলক্ষ্যে দেশটি’তে আজ ছিল জাতীয় ছুটি। এমন এক দিনে আলিবাবা কোয়েন ২.৫-ম্যাক্স ওপেন-সোর্স এআই মডেলটি উন্মুক্ত করায় অবাক হয়েছেন প্রযুক্তি জগতের অনেকেই। কেউ কেউ বলছেন, ডিপসিকের আকাশছোঁয়া সাফল্যের প্রেক্ষাপটে কিছুটা চাপে পড়েই তড়িঘড়ি করে নতুন আই মডেলটি নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে আলিবাবা।
আলিবাবা’র ক্লাউড ইউনিট তাঁদের উইচ্যাট (সোশ্যাল মিডিয়া) অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে কোয়েন ২.৫-ম্যাক্স মডেলটি…… জিপিটি-৪o, ডিপসিক-ভি৩ ও লামা-৩.১-৪০৫বি মডেলগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ অর্থাৎ, আলিবাবার দাবি সত্যি হলে, কোয়েন ২.৫-ম্যাক্স মডেলটি চ্যাটজিপিটি নির্মাতা ওপেনএআই এবং মেটার সবচেয়ে উন্নত এআই মডেলগুলোর চেয়েও বেশি সক্ষম।
গত ১০ জানুয়ারি উন্মোচিত হয় ডিপসিক এআই অ্যাসিসট্যান্ট- যার কেন্দ্রে ছিল তাঁদের ভি৩ (ভিথ্রি) লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম)। এরপর গত ২০ জানুয়ারি ডিপসিকের এআই চ্যাটবটে যুক্ত হয় আর১ (আর ওয়ান) মডেলটিও। ওপেন-সোর্স এই মডেলটি গত কয়েনদিন ধরেই অ্যাপলের অ্যাপস্টোরে সর্বোচ্চ ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপের তালিকায় প্রথম স্থানে অবস্থান করছে।
অ্যাপটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপটে এরই মধ্যে আমেরিকার শেয়ারবাজারে এনভিডিয়ার মতো শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে দরপতন হয়েছে ব্যাপকহারে। ডিপসিকের এআই মডেলগুলো তৈরির খরচ যেমন অবিশ্বাস্যরকম কম তেমনি এগুলো ব্যবহারের খরচও প্রচলিত অন্যান্য এআই মডেলের তুলনায় অনেক কম। অথচ সক্ষমতার দিক দিয়ে ওপেনএআই’র ০১ ও মেটার লামা ৩.৩ মডেলগুলোর সমকক্ষ বলেই দাবি করা হচ্ছে।
ডিপসিকে তোলপাড় চীনের বাজারও
ডিপসিক এআই অ্যাসিসট্যান্ট শুধু আমেরিকাতেই কাঁপন ধরায়নি, চীনের এআই বাজারকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি ডিপসিক তাঁদের আর১ মডেলটি রিলিজ করার পর চীনের এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের নিজস্ব এআই মডেলগুলোর উন্নত সংস্করণ নিয়ে আসতে শুরু করেছে। গত রিলিজ করার জন্য চাপে পড়ে যায়। ডিপসিক-আর১ বাজারে আসার দু’দিন পরই, অর্থাৎ গত ২২ জানুয়ারি টিকটকের মালিক প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্স তাঁদের ফ্ল্যাগশিপ নতুন এআই রিজনিং মডেল ‘দোউবা-১.৫-প্রো’ রিলিজ করে, যেটি সক্ষমতার দিক থেকে মাইক্রোসফট-সমর্থিত ওপেনএআই’র ০১ মডেলকেও ছাপিয়ে গেছে আমেরিকার এআইএমই পরীক্ষায়। এআইএমই বা আমেরিকান ইনভাইটেশনাল ম্যাথমেটিক্স এক্সামিনেশন হচ্ছে বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধানে এআই মডেলের সক্ষমতা প্রমাণের একটি মানদণ্ড।
উল্লেখ্য, ডিপসিকও দাবি করছে তাঁদের আর১ এআই মডেলটি ওপেনএআই’র ০১ মডেলটিকে বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় ছাপিয়ে গেছে। বাইটড্যান্সের পর এবার আলিবাবা নিয়ে এল কোয়েন ২.৫-ম্যাক্স এআই মডেল।
তবে গত বছর থেকেই চীনের এআই’র বাজারে পরিচিতি পেতে শুরু করে লিয়াং ওয়েনফেং-প্রতিষ্ঠিত রিসার্চ ল্যাব ডিপসিক। গত বছর মে’তে ডিপসিকের ভি২ (ভিটু) ওপেন-সোর্স মডেলটি উন্মুক্ত হওয়ার পর আলিবাবা’র ক্লাউড ইউনিট তাঁদের বেশ কয়েকটি এআই মডেলে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমাতে বাধ্য হয়। কেননা ভি২ মডেলটি’তে প্রতি মিলিয়ন টোকেনের জন্য খরচ হতো মাত্র ১ ইউয়ান (শূন্য দশমিক ১৪ ডলার)। একইভাবে চীনের অন্যান্য এআই প্রতিষ্ঠানও তখন দাম কমাতে বাধ্য হয়- যার মধ্যে ছিল বাইডু ও টেনসেন্টের মতো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানও।
লিয়াং ওয়েনফেং গত বছর জুলাইতে চীনের সংবাদমাধ্যম ওয়েভস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তাঁর স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য দাম নয়, বরং তাঁরা চায় এজিআই বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতা অর্জন করতে।
ওপেনএআই’র মনে করে এজিআই হচ্ছে অটোনোমাস (স্বয়ংচালিত) এক সিস্টেম যেখানে এআই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজ একেবারে স্বল্পখরচে ও স্বল্পসময়ে করতে হয়। এক্ষেত্রে মানুষের তত্ত্বাবধান খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। উল্লেখ্য, আলিবাবার মতো বড় বড় চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো’তে যেখানে হাজার হাজার কর্মী কাজ করে, ডিপসিক সেখানে একটি গবেষণা ল্যাবের মতোই অপারেট করে। তাঁদের বেশিরভাগ কর্মীই চীনের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা তরুণ কিংবা ডক্টরেট পর্যায়ের শিক্ষার্থী।
লিয়াং তাঁর জুলাই সাক্ষাৎকারে বলেন যে, চীনের এআই ইন্ডাস্ট্রি’র ভবিষ্যতের জন্য দেশটির বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মানানসই নয়। তাঁর মতে, বিশাল আকারের ফাউন্ডেশনাল মডেলের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় ক্রমাগত উদ্ভাবনের- যেটা করার ক্ষেত্রে টেক জায়ান্টের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকে।
উল্লেখ্য, চীনের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অনুসরণ করে থাকে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে, সেখানে ডিপসিকের অপারেটিং খরচ যেমন অনেক কম তেমনি তাঁদের ব্যবস্থাপনা কাঠামোও অনেকটাই শিথিল।