২০০৫ সালের ৩১ শে মার্চ বাণিজ্যিকভাবে টেলিযোগাযোগ সেবা নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যা ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর কোম্পানি আইন অনুযায়ী -(১৯৯৪)টেলিটক বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে দেশে যখন প্রায় ১৯ কোটি সক্রিয় সিম ব্যবহার হচ্ছে সেখানে teletok এর সক্রিয় সিমের সংখ্যা মাত্র ৬২ থেকে ৬৩ লাখের মতো। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির এই বেহাল দশা কেন? যেখানে একসময় এই প্রতিষ্ঠান সিম ক্রয় করার জন্য মানুষ লাইন দিত সেখানে এই প্রতিষ্ঠানের নামই মানুষ ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এই অবস্থা? তার একটি সংক্ষিপ্ত সারমর্ম তুলে ধরেছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন।
সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকে জানান। বর্তমান সরকার এর ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী সাম্প্রতিক টেলিটক এর প্রধান কার্যালয় এ গিয়ে একটি ঘোষণা দিয়েছেন যে ৬ মাসের মধ্যে টেলিটক কে তিনি লাভজনক অবস্থায় দেখতে চান। তারিখ ঘোষণা এবং বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের একটি মতামত তুলে ধরা আবশ্যক বলে মনে করি বিধায় বিষয়টি গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা তুলে ধরছি।
প্রথমত: এই প্রতিষ্ঠানকে পাবলিক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলা হলেও এই কোম্পানির চেয়ারম্যান বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব। ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে জি এম ,ডিজিএম ,অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক সহ প্রায় ২০-২৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা বিটিসিএল থেকে পেশনে এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত রয়েছেন। নয় সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে এফবিসিসিআইয়ের একজন ব্যক্তি ছাড়া সকলেই প্রায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এই প্রতিষ্ঠানের কোন জবাবদিহিতা নাই । যেহেতু তারা সকলেই প্রায় সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা । সেই সাথে তাদের চাকরির গ্যারান্টি থাকায় তারা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে না। সরকারের তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা এবং প্রতিমন্ত্রী যেখানে পেপারল্যাস কাজকর্ম পরিচালনা করার কথা বলছেন সেখানে ১হাজার ২০ জন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটি দপ্তরের কাজ চলে কাগজে। ফলে ছয় মাসেও আবেদন নিষ্পত্তি হয় না।
দ্বিতীয়তঃ বিনিয়োগ; বাংলাদেশের বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি টেলিযোগাযোগ অপারেটর এর বিনিয়োগ যেখানে ৪৪ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা সেখানে ৬০০ কোটি টাকা দিয়ে শুরু করা টেলিটকের বর্তমানে দেশি-বিদেশি ঋণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের বরাদ্দ, সরকারি বরাদ্দ মিলে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার মতো বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে আমরা লক্ষ্য করেছি। অন্যদিকে থ্রিজি লাইসেন্স ফি এখনো না দেওয়া, তরঙ্গের বকেয়া না দেয়া, রাজস্ব ভাগাভাগি, সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থ বিটিআরসিকে না দেওয়া এবং সরকারের বহু ভবন ব্যবহার করার সুবিধা এই প্রতিষ্ঠানটি পেয়ে থাকলেও সেটি কাজে লাগাতে পারছে না।
তৃতীয়তঃ অপ্রতুল টাওয়ার; যেখানে দেশের প্রথম দ্বিতীয় সাড়ির প্রতিষ্ঠানগুলি বিটিএস টাওয়ার রয়েছে প্রায় ১৯ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১৫০০০ হাজার সেখানে টেলিটকের চলমান প্রকল্প মিলিয়ে টাওয়ারের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৬৬১ টি। এর মধ্যে ফোরজি সাইট উন্নীতকরণ প্রকল্প শেষ হলে চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্কের টাওয়ার দাঁড়াবে দেশে সর্বোচ্চ ১৬০০ থেকে ১৮০০। অর্থাৎ দেশের মোট ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় যার পরিমাণ মাত্র ১৬ শতাংশ। এরমধ্যে দ্রুতগতির মানসম্পন্ন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে এ কথা বলাটাও হবে হাস্যকর।
তৃতীয়ত,: ভুল স্থানে উন্নয়নের অর্থ বরাদ্দ; ২০১২ সালের ১৪ই অক্টোবর থ্রিজি চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ফোরজি চালু হলে থ্রিজি ব্যবহারে মানুষ আগ্রহ হারায়। ফলে টেলিটকের সাইট ফোরজিতে উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করে অন্যদিকে ২০২১ সালে ১২ই ডিসেম্বর তৎকালীন মন্ত্রী দেশের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে জাঁকজম করে পূর্ণভাবে উদ্বোধন করেন। যার ধারাবাহিকতা টেলিটকের 5g প্রকল্প নেয়া হয় যার মোট ব্যয় ২০২৮.২৯ কোটি, জিওবি ৪৬৬ দশমিক ৪৭ কোটি, প্রকল্প সাহায্য পনেরশো ৬১.৮৩ কোটি। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ধরা হয় চট্টগ্রাম ঢাকা সহ মেট্রোপলিটন এলাকা, প্রধান শহর, মেডিকেল কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত সহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে 5g টেলিটক নেটওয়ার্ক চালু করা। এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। কিন্তু গ্রাহকের স্বার্থ চিন্তা করে এবং বাজার প্রতিযোগিতা কে মাথায় রেখে সরকার ও টেল টু এর উচিত ছিল দ্রুত 4g নেটওয়ার্ক সাইট উন্নয়ন করা। এবং এই অর্থ দিয়ে আরও দ্রুত বেশি পরিমাণ সাইট নির্মাণ করা। কিন্তু তারা তা না করে উচ্চবিলাসী একটি ভুল প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। একইভাবে জিও বি অর্থায়নে গ্রাম পর্যায়ে টেলিটকের ৫জি নেটওয়ার্ক উন্নয়নে প্রায় ২২০৪.৩৯ কোটি টাকা খরচ করে এছাড়াও বৈদেশিক ঋণ অর্থায়নে টেলিটক নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি চালু করার প্রকল্প ২ ০ ২৮.২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল থেকে চরাঞ্চল ,হাউর, পাহাড় অর্থাৎ চট্টগ্রামে দুর্গম এলাকায় টেলিটকের ফোরজি মোবাইল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্পে ৭৩৬.০২ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। অর্থাৎ সামাজিক দায়িত্ব তা বিদেশি ঋণ ও জিওবি অর্থায়নে পুরো টাকাটাই জল ও জঙ্গলে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখানে আমাদের যুক্তি হলো এ সকল এলাকায় ট্রাফিক এর সংখ্যা কত? অর্থাৎ রিফান্ড ফেরত এর গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা না জেনেই কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে মোবাইল ব্রডব্যান্ড সম্প্রসারণ প্রকল্প মার্চের ২০২৩ থেকে শেষ ম্যাপ ২০২৫ পর্যন্ত ৬২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জিও বি অর্থায়নে টেলট অফ নেটওয়ার্ক এ বিটিএস সাইটের ডিসি পাওয়ার ব্যাকআপ সিস্টেমের ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সেবার মান উন্নত করার প্রকল্পে ৪৪.৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ চলে গেলে এইখানে কোন পাওয়ার ব্যাক পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ আছে। এছাড়াও হাউর ও পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্যুৎ চলে গেলে পাওয়ার ব্যাকআপ উন্নত করণে ৩৫ কোটি টাকা অযথা খরচ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগকালীন আবহাওয়া পূর্বাভাস তথ্য সেবা প্রদানের জন্য ৪৫ কোটি টাকা খরচ করেছে টেলিটক। কিন্তু এত সকল বরাদ্দ করা হলেও এর সুফল কতটুকু জনগণ পেয়েছে কিংবা রাষ্ট্রকে তারা কি সুবিধানে দিয়েছে সেই সাথে কোম্পানির আদৌ মুনাফা হয়েছে কিনা বা রিফান্ড আসবে কিনা তার সঠিক তদন্ত করে সঠিক ব্যাখ্যা টেলিটক দিবে কি?
চতুর্থ: অপারেটর ভেদে টেলিটকের সাথে তরঙ্গের পার্থক্য; বর্তমানে গ্রামীণফোন এর মোট তরঙ্গের পরিমাণ ১৪.৪০ মেগাহার্স, রবির ১০৪, বাংলালিংক আসি আর টেলিটকের রয়েছে ৫৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ। আবার এই ৫৫ মেগাহ স্তরঙ্গ কতটুকু বা কি পরিমান নেটওয়ার্ক এ যুক্ত করতে পেরেছে তার সঠিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত টেলিটক জানায়নি।
পঞ্চমত :অডিট না হওয়া; অন্যান্য অপারেটরদের প্রতিবছর অডিট হলেও টেলিটকের গত ১৮ বছরেও কোন অডিট এখনো হয়নি। যার ফলে এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি এবং প্রকল্পে অনিয়মের যে অভিযোগ রয়েছে সেটিও জানা সম্ভবপর হচ্ছে না। সেই সাথে কি পরিমান অনিয়ম হয়েছে বা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে কিনা সেটা জানার কোন উপায় নেই।
ষষ্ঠত: রিচার্জ করার জন্য অন্যান্য অপারেটরদের যেখানে প্রায় ৭ থেকে ৯ লক্ষ রিটেলার রয়েছে সেখানে teletok এর হিসাব অনুযায়ী তাদের রিটেলার রয়েছে ২৫ হাজার। বাস্তবে এর চাইতে অনেক কম। ফলে গ্রাহক ভোগান্তি এবং রিচার্জ করতে না পারার বা সিম ক্রয় করতে না পারার ফলে এই সংস্থাটির বিক্রয়ের উত্তর উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই সাথে তাদের কাস্টমার কেয়ার এর সংখ্যা খুবই অপ্রতুল আবার যাও আছে সেখানে গেলে সেবা পাওয়া যায় না বললেই চলে।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই টেলিটকের উন্নয়নে যদি সরকারের সত্যিই একটি সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো যায়, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় লাভ নয় বাজার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য একটি উত্তম প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ করা যায় সে ব্যাপারে আমরা সরকারকে সর্বোত্তম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। পাশাপাশি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিটিসিএল এর যে সকল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ ভি ও আই পি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মন্ত্রণালয় কে তদন্তের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
যে সকল কর্মকর্তার কারণে টেলিটক পিছিয়ে রইল তাদেরকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।