দেশজুড়ে টেলিযোগাযোগ সেবা খাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ করত বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে সুবিধাভোগী ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সক্রিয় রয়েছে এই সিন্ডিকেট। বর্তমানেও তারা বিটিসিএলের কাজ পেতে মরিয়া।
এই সিন্ডিকেটে রয়েছে নিঝুম এন্টারপ্রাইজ, হামিদা ট্রেডার্স, স্কাই লিমিট এন্টারপ্রাইজ, কে কে এন্টারপ্রাইজ ও রিলায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং। নিঝুম এন্টারপ্রাইজ ও হামিদা ট্রেডার্সের নেতৃত্বে সিন্ডিকেটে আছে দুই চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে ও জেডটিই। বিগত সরকারের আমল থেকে বিটিসিএলের কয়েকটি দরপত্রের কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঘুরেফিরে এসব প্রতিষ্ঠানই বাগিয়ে নিচ্ছে সিংহভাগ কাজ। কদাচিৎ সিন্ডিকেটের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পাচ্ছে। সূত্র বলছে, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ‘ম্যানেজ’ করে একচ্ছত্র দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করত এই সিন্ডিকেট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩ কোটি ৮৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবারের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পায় হামিদা ট্রেডার্স। একই বছরের মে মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নয়টি জেলার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও সদর দপ্তর ভবনের মেরামতের কাজ পায় কে কে এন্টারপ্রাইজ। এই কাজের মূল্য ছিল ৬৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৮৯ টাকা। একই বছরের ডিসেম্বরে দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় অপটিক্যাল ফাইবারের ১ কোটি ২৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪৯০ টাকার কাজ পায় নিঝুম এন্টারপ্রাইজ। একই কাজ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি জেলার জন্য পায় হামিদা ট্রেডার্স। এই কাজের মূল্য ছিল ২৭ লাখ টাকা। এর বাইরে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) বেশ কয়েকটি কাজ করেছে হামিদা ট্রেডার্স এবং কে কে এন্টারপ্রাইজ। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির ২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আইসিটি বিভাগের ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্পের অধীন খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, রংপুর-রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং সিলেট-ময়মনসিংহ মোট ৬টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। নিঝুম এন্টারপ্রাইজ (খুলনা), হামিদা ট্রেডার্স (বরিশাল এবং রংপুর), কম্পিউটার সার্ভিসেস স্কাই লিমিট এন্টারপ্রাইজ জেভি (ঢাকা), সিস লজিস্টিক (চট্টগ্রাম) এবং ব্রাদার্স কনস্ট্রাকশন (ময়মনসিংহ-সিলেট) এগুলোর কাজ পায়।
সিন্ডিকেটে বিদেশি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। দেশের ৪২ জেলায় প্রিপেইড ইন্টারনেট সেবা ‘জিপন’ সংক্রান্ত একটি কাজ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া হয় জেডটিইকে। চীনের জেডটিই মূল প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের জেডটিই করপোরেশন যৌথভাবে (জেভি) ১ কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার ২৬১ মার্কিন ডলার (১৫৬ কোটি ৮৩ লাখ ৬০ হাজার ১৪৭ টাকা) মূল্যের এই কাজের কার্যাদেশ পায়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বরে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬৭ মার্কিন ডলার (৩১৭ কোটি ৭৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা) এবং ৩১ কোটি ১০ লাখ ২০ হাজার টাকার আরেকটি কাজ পায় হুয়াওয়ে। ‘৫জি রেডিনেস’ নামে অধিক পরিচিত এক প্রকল্পের অধীন এই দরপত্রের এলসি খোলার অনুমতিও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
অনুসন্ধান বলছে, বিটিসিএলের পাশাপাশি বিএসসিসিএল এবং আইসিটি বিভাগের অধীনেও ফাইবার অপটিক্যাল কেবল সম্প্রসারণের কাজ করে এই সিন্ডিকেট। দরপত্রের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এই সিন্ডিকেট বিটিসিএল, বিএসসিসিএল এবং আইসিটি বিভাগের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘খুশি’ রেখে কাজ করে। তখন মোস্তাফা জব্বার ও পলকের মধ্যে সম্পর্ক শীতল ছিল। কিন্তু এই সিন্ডিকেট তাদের দুজনের সঙ্গেই আন্তরিক সম্পর্ক রেখে নিজেদের কাজ উদ্ধার করে নিত। দুজনের মন্ত্রণালয়ের অধীনেই তারা একচেটিয়া কাজ করেছে। অনেক দরপত্রের কাজ বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়েছে। আবার কাজ পাওয়া কোম্পানির থেকে কমিশনও নিয়েছেন সাবেক দুই মন্ত্রী।
আরেকটি সূত্র বলেছে, নিঝুম এন্টারপ্রাইজের সিরাজুল ইসলাম এবং হামিদা এন্টারপ্রাইজের নুরুল হক এই সিন্ডিকেটের মূল নেতা। তাদের সঙ্গে আছে রিলায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেডিং। দরপত্রে প্রতিযোগিতা দেখানোর জন্য এই সিন্ডিকেটেরই রয়েছে কিছু ডামি প্রতিষ্ঠান। স্কাই এবং কে কে তেমনই কিছু ডামি প্রতিষ্ঠান। কে কে এন্টারপ্রাইজ নিঝুম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলামের ভাগ্নের প্রতিষ্ঠান। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করে নিঝুম এবং কে কে। আর সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের মতো জেলার কাজগুলো হামিদার দখলে।
বিটিসিসিএলের ‘৫জি রেডিনেস’ প্রকল্পের সর্বশেষ এক প্রকল্পে প্রস্তাবিত দর বিশ্লেষণেও এই সিন্ডিকেটের চিত্র ফুটে ওঠে। পাঁচটি লটে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল নেটওয়ার্ক সরবরাহ, স্থাপন, পরীক্ষা এবং চালুর বিষয়ে দরপত্র আহ্বান করে বিটিসিসিএল। প্রতিটি লটে সিন্ডিকেট সদস্য প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত দর একে অপরের বেশ কাছাকাছি। গত ২২ আগস্ট খোলা এই দরপত্রে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ছয়টি কোম্পানি একক এবং যৌথভাবে দরগুলো এমনভাবে প্রস্তাব করেছে যেন পাঁচটি লটের কাজ নিজেদের মধ্যেই থাকে। যেমন লট-১ এ সিন্ডিকেটে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দর ২৪ কোটি ৫৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা দিয়েছে নিঝুম এন্টারপ্রাইজ। তার থেকে তুলনামূলকভাবে সামান্য বেশি দর দিয়েছে জেডটিই। প্রতিষ্ঠানটির জমাকৃত দর ২৪ কোটি ৮১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২৫ কোটি ৬৬ লাখ ১৯ হাজার ৯১০ টাকা দর দিয়েছে যৌথভাবে রিলায়েন্স এবং ফ্ল্যামান্ট। সর্বোচ্চ ২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকার দর ন্যাশনটেকের। এই লটে বিটিসিএলের ধার্যকৃত টাকার পরিমাণ ২৭ কোটি ৪২ লাখ ৪৩ হাজার। একই অবস্থা বাকি চারটি লটেও।
একজন ঠিকাদার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘জমাকৃত দরের ধরন দেখে স্পষ্ট যে, তারা আগে থেকেই জানতেন বিটিসিএলের ধার্যকৃত দর কেমন হবে।’ প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে সব স্বাভাবিক মনে হলেও সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়ার প্রকৃতি বলছে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের যোগসাজশে দর দিয়েছে, যেন লটের কাজগুলো নিজেদের মধ্যেই থাকে।’
অভিযোগ উঠেছে, এই লটগুলোর কাজের জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী জোনাইদ আহমেদ পলককে আগেই মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে রেখেছে সিন্ডিকেট। পলকের নির্দেশে দরপত্রের শর্ত সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠানের সহায়ক করে দুবার পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকল্পের পরিচালক মঞ্জির আহমেদ বলেন, ‘অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের দর যদি কাছাকাছি হয়, সেটা তাদের বিষয়। প্রকল্প কার্যালয়ের এতে কোনো ভূমিকা নেই। অত্র প্রকল্প এবং বিটিসিএলের প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ সততা ও স্বচ্ছতা রেখে দরপত্রের কার্যাদি সম্পন্ন করা হয়।’
এ বিষয়ে নিঝুম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম এবং হামিদা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নুরুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।