বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের ফাইভ-জি প্রকল্পে ২০ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। টেলিটকের চার কর্মকর্তা কোম্পানির মগবাজার অফিসে বসে ওই ঘুষ গ্রহণ করেন। কর্মকর্তারা হলেন- প্রকল্পের তৎকালীন পিডি খায়রুল হাসান, ডিপিডি খালেদ হোসেন, জিএম মামুন ও আশরাফ। মানবজমিনের করা প্রতিবেদন থেকে এই ঘুষ বাণিজ্যের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
প্রকল্পের নাম-এক্সপানশন অফ টেলিটক’স নেটওয়ার্ক আপ টু রুরাল এরিয়াস অ্যান্ড নেটওয়ার্ক রিডিনেস ফর ফাইভ-জি সার্ভিস প্রজেক্ট। বর্তমানে প্রজেক্টটির কাজ অর্ধেকের মতো শেষ হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ২০ কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবেদককে অফিসে কিংবা আলাদাভাবে দেখা করার অনুরোধ জানান। অন্যদিকে হুয়াওয়ে ঘুষ লেনদেন বিষয়ে মানবজমিনের লিখিত প্রশ্নে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে এ ধরনের কোনো লেনেদেন হয়নি বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মূলত টেলিটকের ফাইভ-জি প্রযুক্তিতে নিম্নমানের ডিভাইস ও ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করতে টেলিটকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন এর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, টেলিটকের ফাইভ-জি প্রকল্পে হুয়াওয়ে যেসব ডিভাইস ও ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করছে বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশে এসব ব্যবহার হচ্ছে না। এসব অনাধুনিক হয়ে গেছে। আর টেলিটকের যেসব কর্মকর্তা হুয়াওয়ের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন তারা মূলত ওইসব নিম্নমানের ডিভাইস ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করছি। পাশাপাশি যে সকল কর্মকর্তা ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।
ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে পিডি খায়রুল হাসান বলেন, এসব স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আপনি যদি আমাকে চিনে থাকেন তাহলে বুঝবেন আমি কেমন মানুষ। অন্য তিন কর্মকর্তার দু’জন প্রতিবেদককে আলাদাভাবে দেখা করার অনুরোধ জানান। পাশাপাশি ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
একই প্রসঙ্গে হুয়াওয়ের হেড অব মিডিয়া তানভীর আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঘুষ লেনদেনের প্রশ্নটি লিখিত আকারে দিতে বলেন। পরে ফাইভ-জি রেডিনেন্স প্রজেক্ট নিয়ে টেলিটকের মগবাজার অফিসে টেলিটক এর কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে হুয়াওয়ের অবৈধ লেনদেন হয়েছে-এমন অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে হুয়াওয়ের বক্তব্য কি?
প্রশ্নটি লিখিত দিলে হুয়াওয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘নিজের বার্ষিক আয়ের ১৫ শতাংশেরও বেশি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে হুয়াওয়ে। এ কারণেই টেলিযোগাযোগ খাতে এর সকল গ্রাহককে সবচেয়ে আধুনিক ও কার্যকরী পণ্য ও সমাধান দিতে পারে। আর সে কারণেই হুয়াওয়ে সকলের পছন্দের একটি ব্র্যান্ড। অন্যদিকে ব্যবসায়িক পরিচ্ছন্নতা ও হুয়াওয়ের প্রতি সকলের আস্থার বিষয়টিকেও আমরা অনেক গুরুত্ব দেই। অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো আমাদেরও একটি অভ্যন্তরীণ অডিট টিম রয়েছে যারা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে গত ২৬ বছরের পথচলায় হুয়াওয়ে সবসময় স্থানীয় আইন ও নিয়ম মেনে এদেশের আইসিটি খাতের উন্নয়নে অবদান রেখেছে। তাই অনৈতিক লেনদেনের যে দাবি এখানে করা হচ্ছে সেটা ভিত্তিহীন।’
ফাইভ-জি নিয়ে টেলিটকের সঙ্গে কাজ করার সময় হুয়াওয়ের পক্ষ থেকে দেয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০১২ সাল থেকে গবেষণার ও উন্নয়নের মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরী হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার অ্যালগরিদম তৈরি করেছে, যা অপারেশনের ব্যয় কমানোর পাশাপাশি দ্রুতগতির ফাইভ-জি প্রযুক্তি প্রদানে সক্ষম। বাংলাদেশে ফাইভ-জি চালু করার ক্ষেত্রে হুয়াওয়ে টেলিটককে তার উচ্চমানের জঅঘ ইউনিট প্রদান করবে। এর মধ্যে অঅট (অ্যাকটিভ অ্যান্টেনা ইউনিট), যা ফাইভ-জি যুগে টেলিটক নেটওয়ার্কের কার্যকারিতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে। হুয়াওয়ের অঅট প্রযুক্তির একটি কার্যকারিতা হলো এটি বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি সাইটে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাবে এবং দমকা হাওয়ার চাপেও নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করবে।
যদিও হুয়াওয়ের এসব প্রযুক্তি নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এর আগে বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় বিটিসিএল’র ফাইভ-জি প্রকল্পের কাজ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে। তড়িঘড়ি আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে ওই প্রকল্পের কাজে হুয়াওয়েকে নিয়োগের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রসঙ্গত ২০১৮ সালের ২৫শে জুলাই বাংলাদেশে ফাইভ-জি সেবা পরীক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হুয়াওয়ে টেকনোলজিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড। তখন ৮০০ মেগাহর্স স্পেকট্রাম ব্যবহার করে প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ চার জিবি পর্যন্ত ইন্টারনেটের গতি পাওয়া গিয়েছিল।
পরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলায় হুয়াওয়ে ফাইভ-জি প্রদর্শনীতে ১.৬ জিবিপিএস গতির সাক্ষী করে ঢাকাকে। ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের আইসিটি ও টেলিকম খাতে প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে ভূমিকা রাখছে হুয়াওয়ে। কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি তরুণ-তরুণীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে ফাইভ-জি চালু করতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিকম অপারেটর টেলিটক বাংলাদেশে লিমিটেড সহযোগী হিসেবে নির্বাচন করেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আইসিটি অবকাঠামো ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে। অন্যদিকে টেলিটক একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধনকৃত টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর।