সরকারের ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়িক সংগঠন বেসিস। তবে স্মার্ট ও ক্যাশলেস বাংলাদেশ গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে প্রযুক্তিখাতের মতামত না নেওয়া এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
আজ (১৪ জুন) বেসিস সম্মেলন কেন্দ্রে “ডিজিটাল ব্যাংক: সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ করণীয়” শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় ৫০এর বেশি ফিনটেক প্রতিষ্ঠান,আর্থিক সফটওয়্যার কোম্পানি, ব্যাংক ও মোবাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদের সভাপতিত্বে ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ফিনটেক কমিটির চেয়ারম্যান ফাহিম মাসরুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় মূল উপস্থাপনা করেন ফিনটেক কোম্পানি টালি’পে-র প্রধান নির্বাহী ড. শাহাদাত খান।
আলোচনায় বক্তারা বলেন যে ডিজিটাল ব্যাংককে শুধু সাধারণ ব্যাংকের উন্নত ডিজিটাল সংস্করণ ভাবলে ভুল হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ডিজিটাল ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পেরেছে কেননা সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার মূল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করছে প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারাই তার নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের দেশেও যদি গতানুগতিক ব্যাংক ব্যবস্থার মতো ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিমালা বা লাইসেন্স তৈরী করা হয়, তাহলে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মূল উদেশ্য অর্জন হবে না। বেসিস সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংক এর ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স গাইডলাইন তৈরিতে বেসিসের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স যত বেশি উন্মুক্ত করা যায় ততই এই ক্ষেত্রে বেশি উদ্ভাবন আসবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট শর্ত দেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি ডিজিটাল ব্যাংকের মালিকানার নূন্যতম এক- তৃতীয়াংশ প্রযুক্তিখাতের প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তাদের থাকার জন্য শর্ত থাকা বাঞ্চনীয়। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হতে হলে ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক করা উচিত নয়। যেভাবে বাংলাদেশে প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তারা সফলভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সেবার ক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে, ডিজিটাল ব্যাংকগুলোও সেভাবেই প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বেই তৈরী করার সুযোগ তৈরী করতে হবে। তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী অবশ্যই তারা ব্যাংকারদের নিয়ে কাজ করবেন। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই যাতে নতুন ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স শুধুমাত্র বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে সেই ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
আলোচনার মূল উপস্থাপক ড. শাহাদাত খান অন্যান্য দেশে ডিজিটাল ব্যাংক কিভাবে ব্যাংকিং সেবার বাহিরের বিরাট জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবায় নিয়ে এসেছে তার উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে বর্তমানে ব্যাংকিং সেবা থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা। কোনো ব্যাংক তাদের ঋণ দিতে চায় না কারণ তাদের কোনো তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে নেই। এসকল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বাধ্য হয়ে এনজিও গুলো থেকে বছরে ২৪% সুদে ঋণ নিচ্ছে I ডিজিটাল ব্যাংক এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবা দিতে পারে অনেক কম খরচে। তার জন্য দরকার স্মার্টফোন প্রযুক্তি, ডাটা প্রযুক্তি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এসকল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করার জন্য দরকার উদ্ভাবনী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি পেশাজীবীদের ডিজিটাল ব্যাংকিং নেতৃত্বে নিয়ে আসা। ডিজিটাল ব্যাংক সার্থকভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কিছু প্রস্তুতি দরকার যেমন পার্সোনাল আইডেন্টিটি অথেন্টিকেশন, রিয়েল টাইম ইন্টারঅপারেবল পেমেন্ট এবং সকল ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের ডাটা সম্বলিত কম্প্রিহেনসিভ ক্রেডিট ব্যুরো। এক্ষেত্রে ন্যাশনাল ই-কেওয়াইসি এবং বাংলা কিউআর ভিত্তিক ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এজন্য ব্যাংক, ফিনটেক প্রতিষ্ঠান এবং রেগুলেটরসহ সবাই মিলে একসাথে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন ফিনটেক প্রতিষ্ঠান জয়তুন-এর প্রধান ও ব্যাংক এশিয়ার প্রাক্তন এমডি আরফান আলী, প্রিয়-পের প্রধান জাকারিয়া স্বপন, ক্রেডিট কার্ড নেটওয়ার্ক ভিসা-র ডিরেক্টর সিরাজ সিদ্দিক, ডাটাসফট-এর প্রেসিডেন্ট মনজুর মাহবুব, সূর্যপে-র প্রধান ফিদা হক, ব্র্যাক ব্যাংকের চিফ অপারেটিং অফিসার সাব্বির হোসাইনসহ অন্যান্যরা।