পৃথিবীর সকল প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন। অন্ন, বস্ত্র, বাস্থথান, খাবার ও শিক্ষা পাঁচটি মৌলিক অধিকার। খাবারের উৎসের প্রধান ভান্ডার হলো প্রাকৃতিক সম্পদ। খাবারের পরিবর্তন হয় মূলত রুচি, অভ্যাস, পরিবেশগত অবস্থান, সহজ প্রাপ্যতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে৷ অঞ্চল ভেদে নিজস্ব খাদ্যাভাদ মানুষের উপর প্রভাবিত হয়।
ভারতের মধ্যযুগ ইতিহাস তুর্কি ও মোগলদের দখলে। ১১ শতক থেকে তুর্কি সম্প্রদায়ের যোদ্ধারা ভারতবর্ষের দিকে নজর দিতে শুরু করে যা ১৩ শতকের শুরুর দিকে দিল্লিতে সুলতানশাহি প্রতিষ্ঠার প্রধান ছিলো তারাই৷ মালোয়া যা আজ মান্ডু রাজ বাহাদুর-রূপ মতির প্রেম নামে পরিচিত আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ছিলো সুলতানাদের রাজধাণী দিল্লীতে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই তারা সেখানে স্বাধীন ভাবে রাজত্ব করেছেন (১৪০১-১৫৬১)। খিলজি বংশের তুর্কি সুলতান গিয়াসউদ্দিন (১৪৬৯-১৫০০) ও তার পুত্র নাসিরউদ্দিন (১৫০০-১৫১১) এর সময়ে নেয়ামতনামা নামে একটি রান্নার বই সংকলিত করেছিলেন। যার পান্ডুলিপি বর্তমানে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। মোগল আমলের আগেই যে ভারতে বাদশাহী রান্নার সূত্রপাত, এটি হলো তার উল্লেখযোগ্য নির্দেশন। ধারনা করা হয় মধ্যযুগে ভারতে লেখা একমাত্র রান্নার বই এটি।
ভারতে ১৫২৬ সালে মোগল যুগের সূচনার আগে বাবরের পূর্ব পুরুষ তৈমুর ছিলেন বরলাস নামের এক এক মোঙ্গল গোত্রের মানুষ। তার বসবাস ছিলো মোগলিস্তান বর্তমানে যা দক্ষিন কাজাখস্তান। বরলাস ছাড়াও মোগলদের মধ্যে আরো একটি গোত্র ছিলো যা “চাকতাই” নামে পরিচিত। বাবরের মা ছিলেন এই গোত্রের যা মধ্য এশিয়ার তুর্কি ও মোগল দুই প্রতিবেশী জাতি৷ কালক্রমে মোগলরা তুর্কিদের সাথে মিশে যান যদিও বাবর ও তার বংশধরদের পরিচয় মোগল হলেও তারা নিজেদের মোগল বলতেন না। চেঙ্গিস খান মুসলমান ছিলেন না। মুসলিম হয়েছেন পরে। মুসলমান হওয়ার পর তুর্কি ও মোগলরা উন্নত ইরানি বা পারস্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে মোগল বাদশাদের পারস্যিক সভ্যতার প্রভাব বেশী। যা তাদের রান্না, পরিবেশন রীতিসহ সব কিছুতেই পারস্যের ছায়া খেয়াল করা যায়।
ঢাকার খাবারের মূল বৈশিষ্ট্য মোগলাই খাবারের প্রভাব বেশী। প্রতিদিনের রান্নার আয়োজনে তা এখনও বিদ্যমান। উপমহাদেশে রান্নার ঐতিহ্য তিন ঘরনায় হয়ে থাকে। দিল্লি, লক্ষ্মৌ এবং হায়দারাবাদী।
ঢাকার এক ধরনের খাবারের মধ্যে একাধিক স্বাদ, গন্ধ হয়ে থাকে। যেমন: পোলাও এর মধ্যে রয়েছে আখনি পোলাও, সিমি পোলাও, মতানঞ্জান, মাহি পোলাও, কাবলি পোলাও, তেহারী, মোরগ পোলাও, মতি পোলাও বা কাচ্চি বিরিয়ানি৷
আবার আমরা দেখি পাসন্দ বা সুতলি কাবাব, তেক্কা, জালি কাবাব, মোরগ মোসাল্লাম, গরুর চাপ, টিক্কা, শামি কাবাব, ইলিশ কাবাব, চাপলি কাবাব, মাটন বটি কাবাব কিংবা চিকেন টিক্কা।
রুটি বা পরোটা মানেই সামনে আসে আটা বা চালের গুড়া দিয়ে রুটি। এছাড়াও যে রুটির এতো ভিন্নতা রয়েছে তা কেবল ঢাকার খাবারের ইতিহাস পড়লেই জানা যায়। চাপড়ি, শিরমাল রুটি, ঢাকাই পরোটা, কুলচা, নানরুটি, মোগলাই পরোটা, বাকরখানি, ভিগা রুটি ইত্যাদি।
পোলাও বিরিয়ানি বা রুটি তো হলো এবার মসলাদার কিছু ঢাকাইয়া খাবারের নাম বলা যায়। শাহি মসলাদার খাবার, খাসির বাদশাহী রেজালা, খাসির কোর্মা, মাছের কোফতা কারি, গরুর গোশতের কিমা, করলার কিমা, নারগিসি কোফতা, কোফতা কোর্মা, শাবডেগ, বিরিঞ্জা কোফতা, শিশরঙ্গা, গরুর কালিয়া, গরুর সিনাতালা, মুর্গ মালাই, ফুলকপির কোর্মা, নবাবী পনির, রেজালা, রুই মাছের কোর্মা সহ চিংড়ির মালাইকারী মসলাদার মজার খাবার তৈরী হতো মোঘলদের পাকশালায়।
বাঙ্গালী অতিথিপরায়ণ এ কথা আমরা সবাই জানি। বাড়িতে অতিথি এলে নাস্তার আয়োজনে থাকে নানান খাবার৷আগের নাস্তায় কি দেওয়া হতো তাই একটু জেনে নেওয়া যাক কি বলেন?
খাসি নেহারি, পানতারাস, ফুলরি,দুধ কাচ্চা বিস্কুট, ডাল রুটি, খেতাপুরি, ডাল/আলু পুরি, মালাই পুরি, শাহী হালিম, নিমকপারা, পাপড়, মাষের বড়া, বউখুদি, মুরগির স্যুপ, পনিরের সমুসা, সিঙ্গারা সিঙ্গারা মাখনি, মুড়ি ভর্তা সহ আরো কত কি!
সে সময়ে ঢাকার রান্না ঘরে ইলেকট্রিক চুলা, ফ্রিজ,মিক্সি, মাইক্রোওয়েভ, রাইসকুকার না থাকলেও ছিলো নানান মসলার সাথে পাটা-পুতা,লাকড়ি বা কেরোসিনের চুলার সাথে ধৈর্য্য ও আন্তরিকতার মেলবন্ধন।
উম্মে সাহেরা এনিকা
স্বত্বাধিকারী: তেজস্বী ও প্রতিষ্ঠাতা: ঢাকাপিডিয়া