রোখসানা আক্তার পপি, টাঙ্গাইল জেলার প্রতিনিধি, টেকজুম ডটটিভি // এক পা এগুলে যেন হাজারটা কারণ পিছনে লেগে থাকে দুই পা পিছানোর জন্য। থেমে যেতে হয়তো হয় অনেক কারণেই কিন্ত থেমে থাকিনা আমরা। আমরা নারী, আমাদের এগুতে হয় এভাবেই। আজকের গল্পের উদ্যোক্তা এমন ই একজন যিনি অনেকবার শুরু করেছেন, সফলতার মুখ ও দেখেছেন কিন্তু তারপর ও বারবার তাকে থেমে যেতে হয়েছে বিভিন্ন কারণে। তবে হ্যা থেমে যাওয়া মানেই বসে কখনোই থাকেন নি তিনি, আবারো নতুন উদ্যোমের সাথে শুরু করেছেন নিজের উদ্যোগ, নিজের পথচলায় নানা চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে নিজের লক্ষ্যে অটুট থেকে করে যাচ্ছেন একের পর এক কাজ এবং হয়েছেন সফল।টাঙ্গাইল এর একজন উদ্যোক্তা, একজন প্রশিক্ষক আমিরজাদি আমিনা খাতুন।
নিজে যেমন একজন উদ্যোক্তা তেমনি একজন সফল ট্রেইনার আপু। বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন একটি ট্রেইনিং সেন্টার এবং এখানে নারীদের হস্তশিল্পের উপর পারদর্শী করে গড়ে তুলতে তাদের ট্রেইনিং দিয়ে থাকেন আপু। অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করে আপু এলএলবি করেছেন এবং এখন টাঙ্গাইল ল কলেজের প্রভাষক হিসেবে আছেন। পাশাপাশি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর,যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে,BWCCI এর বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
টেকজুম: উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু কিভাবে?
আমিরজাদি আমিনা : “মজার একটা ব্যাপার ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমি কখনো সেলাই বা হস্তশিল্পের কোন কাজ করিনি।পছন্দই করতামনা।মোটামুটি ভাল ছাত্রী ছিলাম।পড়াশোনা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিয়েই মাতামাতি ছিল।সেলাই কাজটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলনা আমার কাছে। আব্বা যখন টাঙ্গাইল বদলি হয়ে আসেন তখন আমি প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে যাই ।ঐ সময়টায় আমি ইসলামি বই এবং সেলাই এর দিকে আগ্রহি হই।দেখলাম একবার দেখলেই আমি খুব ভালভাবে পারছি।আর এই কাজটাই পরবর্তীতে আমাকে উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। প্রথম শুরুটাও প্রয়োজনে ছিল। নিজে কিছু করবো সে আশায়।কারণ আমি যখন অনার্স ভর্তি হই তখন আব্বা চাকরিতে অবসরে যান।প্রয়োজন এবং নিজের পরিচয় তৈরি করার জন্যই আমার উদ্যোক্তা হতে আসা।”
কাজের শুরুটা ছিলো ২০০২ এ মূলত হাতের কাজের পোশাক নিয়ে।। যদিও বিভিন্ন কারণে তা অনেক বার ই বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০১৪ তে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়। খুব ই দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে এটাও বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু আপু এখন একজন সফল মানুষ। আমার উদ্যোগ “ঐতিহ্য হস্তশিল্প” এবং “ঐতিহ্য হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টাঙ্গাইল। উদ্যোগ এ আছে বিভিন্ন পণ্য, যেমন কুঁশিকাটার তৈরি বিভিন্ন পণ্য, পাটজাত পণ্য, নকশী কাঁথা, হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, ব্লক, বাটিক, হাতের কাজ সহ অনেক কিছু৷
টেকজুমঃ ক্যারিয়ারে ই-কমার্স কেন বেছে নিলেন?
আমিরজাদি আমিনা :“হঠাৎ নয় অনার্স পড়ি তখন থেকেই আমি এই কাজের সাথে যুক্ত। আমার বই কেনা প্রাইভেট পড়া, নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু আমার উপার্জনেই করেছি। তখন থেকেই ভেবেছি যদি বিসিএস না হয় তবে উদ্যোক্তা হব। আর এখন ই কমার্স উদ্যোক্তা হওয়া অনেকটা প্রয়োজনে। অন্যায়ভাবে চাকরি হারানো, করোনার কারণে ছোটভাই এর প্রাইভেট কলেজের না থাকার মত চাকরি, বাবার মৃত্যু সবমিলিয়ে আমার ব্যাস্ত থাকা এবং উপার্জনের জন্য এ দিকে মনোযোগী হয়েছি।”
টেকজুমঃ প্রশিক্ষক হিসেবে ধরনের কাজ করে থাকেন?
আমিরজাদি আমিনা : এর ই মাঝে ২০১২ তে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এ প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করি। সরকারি বেশ কয়েকটি প্রকল্পে প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন৷ তখন তিনি দেখতেন যে অনেক নারীদের জন্য ট্রেইনিং গুলো নেয়া সম্ভব হতোনা অনেক কারণেই৷ অনেকে দীর্ঘমেয়াদি ৩ মাস, ৬ মাসের ট্রেইনিং গুলো নিতে পারতেন না সময়ের অভাবে কিংবা অনেক গৃহিনীর ইচ্ছা আছে কিন্তু সুযোগ হতোনা তাদের অনেকেই আপুকে বলতেন একটু শিখিয়ে দিতে। আপুর কাছে অল্প সময়েই অনেকেই খুব সুন্দর ভাবে শিখে যেতেন বেশ কিছু বিষয়ে। এর ই পরিপ্রেক্ষিতে আপু নিজ উদ্যোগ এ ট্রেইনিং সেন্টার শুরু করেন ২০১৪ সালে। যেখানে নারীদের তাদের সুবিধামত সময় নিয়ে ট্রেইনিং দেয়া হয়। কেউ শিখে ব্লক, কেউবা বাটিক, কেউ হাতের কাজ, অনেকেই পাটপণ্য তৈরি, অনেকেই শিখছেন এমব্রয়ডারি কিংবা কেউ অন্যান্য পণ্য তৈরি৷ ইভেন এর পাশাপাশি আছে কৃষিপণ্যের উপর ট্রেইনিং যেমন মাশরুম চাষ, হাঁস মুরগি পালন, নার্সারি। এ দায়িত্বে আছেন আরেকজন প্রশিক্ষক। সব মিলিয়ে আমাদের টাঙ্গাইল শহরে আপুর এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবীদার।
টেকজুমঃ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছিঃ
আমিরজাদি আমিনা :🔸প্রথম বাধা মেয়ে মানুষ।আজ থেকে বিশ বাইশ বছর আগে মেয়েদের ব্যাবসা করা কেউ মেনে নিতে পারতনা।মেলা করতে গেলে তো কথাই নেই।মেয়ে মেলায়,বাজারে ঘোরে এ মেয়ের ভাল বিয়ে হবেনা।করলেও বিয়ের বিয়ের পর করো যদি স্বামী করতে দেয়।এজন্য উদ্যোগ শুরু করার জন্য দু হাজার টাকাও কেউ দেয়নি।কিন্তু চাকরির জন্য লাখ টাকা দিতে প্রস্তুত।কারণ চাকরি নিশ্চিত আর ব্যবসা অনিশ্চিত।যদি লস হয়।সামাজিক ব্যবস্থাটাই এমন।
🔸প্রয়োজনীয় কাঁচামালের স্বল্পতা।
🔸বিক্রির সমস্যা।তখন অফলাইনে কাজ করতাম। আবার বিক্রি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করেন না।এখনো অনেকের কাজে আমার হাজার হাজার টাকা পড়ে আছে।
আসলেই উদ্যোক্তা হতে হলে ফুল সাপোর্ট টা আমরা খুব কম মানুষ ই পাই। এর পরে ও আমাদের এগুতে হয়, এগুই আমরা এবং সফল হই এর একটা ই কারণ তা হলো ইচ্ছাশক্তির জয় সর্বত্র আর নিজের ভালোলাগার কাজে এফোর্ট টা ও বেশিই দেয়া যায়।
টেকজুমঃ নিজের পণ্যের সম্ভাবনা নিয়ে আপু আমাদের জানান
আমিরজাদি আমিনা :“অপার সম্ভাবনা। কারণ আমার সেক্টরটা পোশাক বা কাপড় কেন্দ্রিক।তো যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে ততদিন এর প্রয়োজনও থাকবে।শুধু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কিছু নতুনত্ব যোগ করতে হবে।
আমার কুশি পণ্যের কথাই ধরি। শীতের যে পোশাকগুলো হয় তা আমাদের দেশে দু-মাস ব্যবহারযোগ্য হলেও শীতপ্রধান দেশে এর চাহিদা সবসময়।তাই এই পণ্যটি রপ্তানি পণ্য হতে পারে। নকশি কাঁথার জনপ্রিয়তাও আমরা জানি।লাখ টাকা পর্যন্ত দাম আছে এবং বেশ আগে থেকেই বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
আবার বাটিকের ক্ষেত্রে যদি বলি প্রাকৃতিক রঙের বাটিকের চাহিদা বাড়ছে।কারণ এটি স্বাস্থ্যসম্মত।বিশেষ করে ইন্ডিগো বা নীল থেকে রঙ করা বেশি জনপ্রিয়।দেখতেও সুন্দর। আমরা এনিকা আপুর উদাহরণ দিতে পারি।
পাটজাত কলাগাছ বা আনারসের আঁশের পণ্যের কথা বললে এগুলোর চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই।কারণ এগুলো পরিবেশ বান্ধব।বিশেষ করে দেশের বাইরে এর চাহিদা অনেক বেশি।তাই এই সেক্টরে কাজের সুযোগ রয়েছে এবং সম্ভাবনাও যথেষ্ট।”
টেকজুমঃ ই-কমার্স এর সাথে নিজেদের আপডেট করা কতটুকু যুক্তিসম্মত মনে করেন?
আমিরজাদি আমিনা : ই-কমার্স এর কোন বিকল্পই নেই। সময়ের সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হয়। এর সাথে তাল মেলাতে হলে নিজেকেও ওভাবে তৈরি করে নিতে হবে। এটা অবশ্যই যৌক্তিক এবং সময়ের দাবি। এখন আপু ই-কমার্সকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আর এই সেক্টরের যাবতীয় খুঁটিনাটি উই, ডিএসবি গ্রুপ থেকে জানতে পারেছি। শ্রদ্ধেয় রাজীব স্যারের রিডিং সিলেবাস আপুর রিডিং, রাইটিং, স্পিকিং সবটাতেই পরিপক্ক হতে সাহায্য করছে, ইংরেজিতে নিজে দক্ষ হয়ে উঠছি।আরিফা মডেলের মাধ্যমে দেশিয় অনেক পণ্য নিয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে নতুনভাবে যা আপুকে খুব অনুপ্রাণিত করছে।
টেকজুমঃ নতুনদের জন্য কিছু বলেন?
আমিরজাদি আমিনা : না জেনে হুট করে বা শখের বশে আসা উচিত না। এটি শখের কাজ নয় খুব সিরিয়াস কাজ। অফলাইন বা অনলাইন যেভাবেই হোক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে আগে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। এজন্য অনেক সুযোগ রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে।
টেকজুমঃ আপনার প্রতিষ্ঠান এর সফলতা কামনা করছি এবং অনেকটা বছর লেগে থাকার এ মানসিকতার জন্য সাধুবাদ জানাই । ধন্যবাদ টেকজুম কে সময় দেবার জন্য৷
আমিরজাদি আমিনা : ধন্যবাদ টেকজুম কে এবং আপনাকেও