নারী উদ্যোক্তাদের সম্মান জানাতে এবং অনুপ্রাণিত করতে পালিত হয় নারী উদ্যোক্তা দিবস। প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিকে গতিময় করতে কাজ করে যাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা। উদ্যোক্তা হিসেবে অর্থনীতিতে নারীর প্রবেশ যেমন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছে, তেমনি ছড়িয়ে দিচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত।
করোনা মহামারির শুরু থেকে অনেক বেশি নারী সম্পৃক্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে। আর দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম)। (উই) গ্রুপের কল্যাণে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে হাজারো নারী। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম এর মাধ্যমে সফল দেশি পণ্যের উদ্যোক্তাদের নিয়ে নারী উদ্যোক্তা দিবস ২০২০ এ টেকজুমের বিশেষ আয়োজন ।
স্বামী এডভোকেট সুমন চন্দ্র নাগের পরামের্শ ও সহযোগীতায় প্রিয়দর্শিনী নামে ফেসবুকে বিজনেস পেজ তৈরি করেন শমরিতা নাগ। শুরু টা ইন্ডিয়ান শাড়ি দিয়ে হলেও বর্তমানে উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর কল্যাণে বিক্রি করছেন দেশিয় পণ্য। বিক্রি করেন রাজশাহী সিল্ক, বলাকা সিল্ক ও লক্ষীপুরের ঐতিহ্যবাহী নারিকেল কুচার সন্দেশ। তিনি বলেন, মানসিক ভাবে ভেঙে বিপর্যস্ত হওয়ার পর অনলাইন বিজনেস চালু করি।
২০০৮ সালে অর্থনীতিতে অনার্স শেষ করে উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন আসমা হক কান্তা। প্রকৃতির খাঁটি জিনিস দেওয়ার নিশ্চয়তায় প্রতিষ্ঠা করেন ধবল। যার (ধবল) অর্থ সাদা, কালিমা নেই, সব শুদ্ধ। প্রথমে গরুর খাটি দুধ দিয়ে শুরু হলেও পরে যোগ করে আচার, সরিষার তেল, ঘি, নারকেল তেল, পিঠা, স্ন্যাকস, মসলা সহ আরো কিছু দেশীয় পণ্য। করোনাকালীন সময়ে ব্যবসার গতি কমলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেয়নি উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। নারী উদ্যোক্তা দিবসে তিনি বলেন, নানান চরাই উৎরাই পার করে ১৫ জন মানুষের কর্মসংস্থান ও কাস্টমারের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। তিনি আরও বলেন, মেয়েদের ব্যবসা করতে আমাদের সমাজে অনেক বাঁধা। এর মধ্যে অন্যতম অন্যের মানুষিকতা, তুমি পারবে না বলে, বলা হয় ব্যবসা মেয়েদের জন্য না। সহযোগিতার হাত নাও থাকতে পারে কিন্তু বাঁধা না দিক তাহলেই মেয়েরা এগিয়ে যাবে।
তিন বছর আগে শখের বশে পরিধান শৈলী নামে ফেসবুকে পেজ তৈরি করে ব্যবসা শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাকিমুন জয়া। ধীরে ধীরে স্বপ্ন ও প্যাশনে পরিনত হয় পরিধান শৈলী। উইতে জ্ঞান অর্জন করে ঢেলে সাজায় নিজের বিজনেস। শুরু থেকেই দেশি শাড়ি নিয়ে কাজ করেন এ নারী। ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে দেশি পণ্যের রাজত্ব শুরু হওয়ায় দেখতে পায় স্বপ্ন পূরণের আশার আলো। নারী উদ্যোক্তা দিবসে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্যের পথে পিছুটান দেয়ার মতো থাকবে অনেক মানুষ। এসব উপেক্ষা করে নিজের স্বপ্ন ও লক্ষ্যের দিকে ফোকাস রেখে এগিয়ে যেতে পারলে সফলতার দাড়ঁ আপনাআপনি উন্মুক্ত হবে আমাদের।
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে দেশীয় চা পাতার আসল স্বাদ সবার কাছে পৌছে দেয়ার প্রত্যয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নিপা প্রতিষ্ঠা করেন জান্নাত টি-ভ্যালি। কোভিড-১৯ তে সকল ব্যবসা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, জান্নাত টি ভ্যালিতে অর্ডার আসতে থাকে সারাদেশ থেকে। তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশে ২০-৩০ ধরনের গ্রীন টি উৎপাদন হবে। নারী উদ্যোক্তা দিবসে তিনি বলেন, আমি একজন গর্বিত নারী উদ্যোক্তা। সকল নারী উদ্যোক্তাদের জানাই প্রানঢালা শুভেচ্ছা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় ২০১৮ সালে দেশীয় পণ্য নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ তৈরি করেন নৃ বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা জান্নাতুন নাহার লিয়া। দেশের বিখ্যাত পোশাক জামদানী, মনিপুরী, হ্যান্ডপেইন্ট ও বিভিন্ন মোটিফ এর ব্লক উড়োজাহাজ, চায়ের কাপ, সাইকেল ইত্যাদি বিক্রি করেন। দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশে যতবার গেছি, তাদের (বিদেশী) নিজেদের কালচার রিপ্রেজেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমার ইচ্ছা পহেলা বৈশাখ, শীত, বর্ষা, ঈদ ইত্যাদি সিজনাল পণ্য দেশি-বিদেশে বিক্রি করা।
লেখাপড়া শেষ করে ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও শারমিন সাঈদ অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে হয়েছেন উদ্যোক্তা। নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে ফেজবুকে চালু করেন ইনোভেটিক ফ্যাশন পেজ। বিক্রি করেন মুন্সিগঞ্জের ২০০ বছরের ঐতিহ্য পাতক্ষীর, ব্লকের শাড়ি, তাঁতের শাড়ি- থ্রী পিস, নিজের ডিজাইনার কুর্তি। মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্যোগ পরিচালনা করায় কাচামাল সংগ্রহ, কুরিয়ার জটিলতা এবং ব্যবসায় দিনের পর দিন লস দিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। তখন ফেসবুকে সন্ধান মিলে দেশি উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের। এখানে কোন প্রকার বুস্ট বা খরচ ছাড়া শুধু পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং দিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন তিনি।
ময়মনসিংহ থেকে কাজ করেন আফাফ ক্রিয়েশনের উদ্যোক্তা আরিফা খাতুন। বিক্রি করেন বেবী ড্রেস, টাঙ্গাইল শাড়ি, ফ্যামেলী ম্যাচিং ড্রেস। শুরুতে সবকিছু নিজে করলেও উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) তে যুক্ত হওয়ার পর বর্তমানে ৫ জন কারিগর কাজ করেন তার অধীনে। নারী উদ্যোক্তা দিবসে তিনি বলেন, আমি কাজ করতে চাই নারীদের জীবনমান উন্নয়নে। অর্থনৈতিক ভাবে তাদেরকে স্বচ্ছল করতে চাই।
উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এই তিন সফল ব্যবসায়ী সহায়ক হিসেবে পাশে পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম’ বা উই,। এইধরনের হাজারো নারী উদ্যোক্তাদের সফল ব্যবসায়ী হতে সহায়ক ভুমিকা রেখে চলেছে উই । দেশের অর্থনীতিতে নারীদের আর্থিক অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কাজ করা সংগঠন প্ল্যাটফর্ম ‘ওমেন অ্যান্ড ই কমার্স ফোরাম’(উই) এর সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, আমি প্রথমে সকল নারী উদ্যোক্তাদের শুভেচ্ছা ও অভিন্দন জানাতে চাই আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবসের । দেশের সকল নারী উদ্যোক্তাদের সামনে এগিয়ে আসার আহবান করছি । যে সৎ থেকে এবং ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেনা সে কখনোই সামনে এগোতে পারবে না এবং ধৈর্য অনেক বড় একটা গুণ যে ধৈর্যের সাথে এগিয়ে যাবে সেই সামনে সাকসেস হবে । এই ব্যাপারগুলো উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনে আসল বিষয় যেগুলো আমাদের নারীদের খেয়াল রাখতে হবে । তিনি আরো বলেন, আমি যে কাজ হাতে নেই, সেটার সাথে সততা থাকে, থাকে আন্তরিক চেষ্টা। যেটা আমি পারবো না, সেটা আমি কখনোই নেইনা এবং নিজের কাজ অন্যের উপর ও চাপিয়ে দেইনা। সব নারীদের জন্য এটাই আমার বার্তা। সৎ থাকুন, অন্যকে সৎ থাকতে সাহায্য করুন। আপনার একার জন্য সমগ্র নারী সমাজের নাম যেন খারাপ না হয় ।