বর্তমান বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার মুন্নুনপাড়া ইংলিশ মিডিয়াম জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষক স্বর্গীয় থাংচুল বম মাস্টার ১৯৬৬ সালে রুমার বেথেলপাড়া নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। তিনিই প্রথম ১৯৬৭ সালে বেথেলপাড়ায় প্রথম কাজুবাদামের গাছ রোপন করেন। শুরু হয় সীমিত আকারে কাজুবাদামের চাষ। ইতোপূর্বে ১৯৬২ সালেও কাজুবাদামের চারা কাপ্তাই লেক পুনর্বাসন এলাকায় প্রদান করা হয়েছিলো বলে জানা যায় কিন্তু সেটা বানিজ্যিক রূপ লাভ করেনি।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের দিকে বানিজ্যিকভিত্তিতে রুমার বেথেলপাড়ায় ১৫পরিবার এবং পাইন্দু এলাকায় ১০পরিবার কাজুবাদাম চাষ শুরু করেন। এরপর থেকে এই কাজুবাদামের চাষ সমগ্র পার্বত্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে কাজুবাদাম বিক্রি হতোনা। ১৯৮০ সালের দিকে কাজুবাদাম বিক্রি শুরু হয়। যা এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
প্রথম দিকে কাজুবাদাম তেমন বিক্রি হতোনা। শুধু কাজু আপেল যা স্থানীয় ভাষায় টাম ফল বলা হয় সেটা খাওয়া হতো। আর কাজুবাদামের শেলসহ লাকড়ি দিয়ে পুড়িয়ে বাশ বা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বাদাম বের করা হতো। আর এই বাদাম লবন, মরিচ মিশিয়ে জুড়ং (আমরা যাকে হামান দিস্তা বলি তার স্থানীয় নাম) দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া হতো। আর এই ভর্তা খাওয়া হতো সাধারণত শাক সিদ্ধ, বা অন্য কোন সব্জী সিদ্ধ এর সাথে। এখনো বম সম্প্রদায়ের লোকজন আগের মতই বাদাম পুড়িয়ে খায়।
রুমা উপজেলায় কাজুবাদাম বাগান সরেজমিনে পরিদর্শনকালে বম সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে কথা বলে যা জানলাম এখনো কাজুবাদামচাষীরা সেই মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এই প্রসংগে মুনলাই পাড়ার কার্বারী (পার্বত্য এলাকায় কার্বারী অর্থ হচ্ছে গ্রাম প্রধান) বাবু লিয়েন অং বম বলেন “আমরা এখনো আগেকার দিনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, আমাদেরকে যদি প্রশিক্ষণ আর সরকারী কিছু সুবিধা দেয়া হতো তাহলে আমরা আরও ভালো এবং বেশী পরিমাণ কাজুবাদাম উৎপাদন করতে পারতাম।”
বর্তমানে পার্বত্য এলাকার কাজুবাদামের চাষাবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তথ্যমতে পার্বত্য এলাকায় কাজুবাদামের আবাদ ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ অর্থ সালে যথাক্রমে ৩,৭৬৭ একর, ৩,৭৬৭একর এবং ৫,৩০৮ একর। এই তথ্য থেকে সহজেই দেখা যায় যে, দিন দিন কাজুবাদামের আবাদের পরিমান বাড়ছে। এই প্রসংগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত পরিচালক বাবু পবন কুমার চাকমা জানান যে, “পার্বত্য এলাকায় অনেক আগে থেকেই বানিজ্যিকভাবে কাজুবাদাম চাষ শুরু হয় কিন্তু মাঝে কয়েক বছর বাজারজাত আর প্রসেসিং এর অভাবে উৎপাদন কিছুটা কমে গিয়েছিলো। বিগত কয়েক বছর যাবত আবার কাজুবাদামের আবাদ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু কাজুবাদাম পচনশীল দ্রব্য নয় তাই সংরক্ষণ করা যায় সহজেই। বর্তমানে কাজুবাদামের বাজার আবার সৃষ্টি হয়েছে এবং কৃষকরাও এক্ষেত্রে আগ্রহী তাই আমি আশাবাদী আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কাজুবাদামও দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানীযোগ্য একটি অন্যতম পন্য হিসাবে আবির্ভূত হবে।”
এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এর অধীন খাগড়াছড়িতে অবস্থিত পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকতা জনাব ডঃ মুন্সী রাশিদ আহমেদ বলেন ” পার্বত্য এলাকার কাজুবাদামের প্রধান সমস্যা হলো প্রকৃত জাত নির্বাচন, আন্তঃপরিচর্য্যা এবং প্রসেসিং। কৃষকদেরকে ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সম্প্রতি জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা FAO এই বিষয়ে কাজ করছে। কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাজ করছে। প্রশিক্ষন আর সহযোগিতা দিলে কৃষকরা আগামী ২/৩বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াবে আশা করি।”
বাংলাদেশের দেশী পন্যের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম উই যেভাবে দেশী পন্যকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সারা দেশের মানুষের কাছে এবং বর্তমানে যেভাবে দেশের মানুষের কাছে দেশী কাজুবাদাম এর চাহিদা বাড়ছে আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই কাজুবাদাম চাষ আরও সম্প্রসারিত হবে এক্ষেত্রে কৃষকদের জন্য সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থাগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ভবিষ্যতে কাজুবাদাম হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানীমুখী পন্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।
শিরীন সুলতানা অরুনা
রাংগামাটি থেকে