বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও, বাস্তবে সেই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ছাত্রদল ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এখন চরম আতঙ্ক ও সংশয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ আগস্ট রাতে সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত আসে, যেখানে মূল দাবি ছিল রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পরও, ছাত্রদল ১৫ বছর পর আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে তাদের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কামাল-রণজিৎ মার্কেটে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে তারা সংগঠিত হচ্ছে বলে জানা যায়।
জানা যায়, সম্প্রতি শহীদ আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে ছাত্রদল দলীয় ব্যানারে মৌন মিছিল ও সমাবেশ করেছে, যা নিষেধাজ্ঞার পর প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এরপরই ছাত্রদলের রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানালেও, অন্যরা মনে করছেন যে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হবে না।
এদিকে বাকৃবিতে গঠিত তদন্ত কমিশনের কার্যক্রম ঘিরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হওয়ায় ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারা হারাতে পারেন ছাত্রত্ব, এমনকি বাতিল হতে পারে তাদের সার্টিফিকেটও। আবার যারা এতদিন নির্যাতন, অন্যায় ও অপকর্মে জড়িত ছিল ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষা দিতে এলে ভয়ে ও সংশয়ে থাকছে সবসময়।
একজন ছাত্রলীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তদন্ত কমিশন গঠিত হওয়ার পর থেকেই আমরা সবাই ভীত। কেউ জানে না, কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ উঠে আসবে। আমাদের কেউ ছোটখাটো বিষয়েও অভিযুক্ত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
আরেক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে এমন কিছু ঘটে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। কিন্তু শুনেছি কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত হচ্ছে। যদি কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে সার্টিফিকেট বাতিলের মতো কঠিন শাস্তি পেতে হতে পারে, যা নিয়েই সংশয়ে আছি। তবে তদন্ত কমিশনকে অনুরোধ জানাব, ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে কেউ যেন শাস্তি না পায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এ তদন্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতি দূর করতে সহায়ক হবে। তবে ছাত্রলীগের নেতারা মনে করছেন, অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে। তবে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়ে কড়া হুশিয়ারি দিয়েছে তদন্ত কমিটি। কারোর দেওয়া অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকার।
অন্যদিকে সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ভোল পাল্টে এখন ছাত্রদলের দিকে ঝুঁকছেন। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ক্যাম্পাসে ছাত্রদল যখন নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে, তখন ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন সদস্যও এ সুযোগে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে নিজেদের নতুন পরিচয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করছেন এবং ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারের জন্য নতুন দলীয় কাঠামোতে স্থান করে নিতে চাচ্ছেন।
বাকৃবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. আতিকুর রহমান বলেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সবসময়ই মননশীল ও মেধাভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমরা চাই, বাকৃবিসহ দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকুক এবং মেধা বিকাশের পথে থাকা সব ধরনের বাধা দূর হোক। এই আদর্শ ও প্রত্যাশা থেকেই বাকৃবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। আবরারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ফ্যাসিস্ট শাসকদের দোসর, বুয়েট ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতাদের বিচারের দাবিতে এবং আবরারের আত্মার মাগফিরাত কামনায় তারা তার মৃত্যুবার্ষিকীতে মৌন মিছিল করে প্রতিবাদ করেছে। ৩৬শে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদমুক্ত গণতান্ত্রিক, মেধাভিত্তিক, আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ গঠন করা, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার জন্য সুনিশ্চিত থাকবে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, গণতান্ত্রিক ও মেধাভিত্তিক আধুনিক বাংলাদেশ গঠন কোনোভাবেই বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে সম্ভব নয়। বরং সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার মাধ্যমেই এটি নিশ্চিত করা যেতে পারে, যার জন্য বিকল্প কোনো শর্টকাট পথ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলীয় ব্যানারে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করার সুযোগ নেই। ছাত্রদলের সদস্যরা দলীয় ব্যানারে মিছিল ও সমাবেশ করার পর তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, বিষয়টি তারা ভালোভাবে বুঝতে পারেননি। সামনে এ ধরনের কাজ আর করবে না। বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিল, মানববন্ধন দেখে তারাও ভেবেছিল যে সমস্যা হবে না। আমার জানা মতে, হলগুলোতে ছাত্রদল নাম করে কেউ সক্রিয় নেই।