আলুপ্রিয় জাতি আমরা। সবকিছুতেই ঘুরেফিরে আলু খুব বেশিই প্রায়োরিটি পায়৷ আলু ছাড়া আমার তো অনতত একটা দিন ও কাটেনা, এতটা ই পছন্দ আমার আলু। সবকিছুতেই নতুনত্ব খুঁজেফেরা আমাদের চাহিদার মাঝেই পরে। খাদ্যেও ইদানীং অনেক নতুনত্ব যোগ হচ্ছে। রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, আমরা আরো বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে পরছি এবং এর সাথে খাদ্য তালিকায় পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার যোগ হচ্ছে। তাই কৃষিবীদরা ও নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন। এমন ই একটি সবজি পার্পেল আলু৷
এই সবজি টা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। আমাদের দেশে কিছুদিন আগে পরীক্ষামূলক ভাবে এবং শখের বসে এটি চাষ হলেও গত বছর থেকে এই সেক্টর এ উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছেন। টাঙ্গাইল এর মধুপুর এ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ আলুর চাষ এবং সফলতায় অনুপ্রেরণা পাচ্ছে অনেকেই। কাজ করার আগ্রহী এখন অনেক চাষী এবং বেশ কিছু উপজেলায়।
ষোল শতকের দিকে পেরু ও বলিভিয়া থেকে এর যাত্রা শুরু হলেও নতুনভাবে উদ্ভাবন হয় ১৯৮০ সালের মাঝামাঝিতে আমেরিকায়৷ জাপানি ও আমেরিকান জাত এর এ পার্পেল পটেটো বা বেগুনি মিষ্টি আলু অনেক চাহিদাসম্পন্ন এর স্বাস্থ্যপকারিতা এবং এর সুন্দর রঙ এর জন্য । এখন বেশ কয়েকটি দেশ যেমন দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এ এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
আমাদের দেশে যে জাতটি চাষ হচ্ছে তা প্রায় ১৩ বছরের গবেষণার ফল। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর একদল গবেষক এই গবেষণা করেন এবং ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী জাতীয় বীজ বোর্ড জাতটিকে অনিয়ন্ত্রিত জাত হিসেবে নিবন্ধন করেন। এই গবেষক দল জাপান ও মালয়েশিয়ার প্রায় ১৫ থেকে ১৬ টি মিষ্টি আলুর জাত নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর এই নতুন জাতটি বাংলাদেশ এ সফলভাবে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে, যা পার্পেল স্টার নামে পরিচিত। এটি আমাদের টাঙ্গাইল এর মধুপুরেও চাষ করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবেই।
মধুপুর এলাকা জুড়ে আগে থেকে ই প্রায় ৫০ একর এর ও বেশি জায়গা জুড়ে মিষ্টি আলুর চাষ হয়, সেখানে এই পার্পেল আলু যেমন নতুন, তেমনি বাণিজ্যিক ভাবে খুব ই সফল হতে পারে বলে ই জানা যায়।।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং চাষী রা সবাই খুব বেশি আশাবাদী, যার কারণে এই আলুর উপরে ই দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ কৃষকদের। “কান্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প” নামে একটি প্রকল্প ও নেয়া হয়েছে এই প্রশিক্ষণ এর জন্য।।।।
পার্পেল আলু চাষ এ খরচ একেবারেই কম। মধুপুর এ প্রচুর আনারস হয় এটা আমরা সবাই জানি। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে আনারস এর সিজন এর পর জমি ৪ মাস এর মত পতিত অবস্থায় পরে থাকে। পার্পেল আলুর খুব বড় সুবিধা হলো এটি চাষ এর জন্য আলাদা জমির প্রয়োজন হয়না, পতিত এসব জমিতেই এর চাষ করা সম্ভব এবং ফলন ও খুব ভালো। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এ এই আলুরনকন্দ বা চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। প্রতি শতকে ২ মণ।। দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটি এর জন্য উপযোগী হলেও যত্ন কম লাগার দরুণ এরা প্রায় সব ধরণের মাটিতেই নিজেদের খাঁপ খাইয়ে নিতে পারে যা এই আলুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
চাষ পদ্ধতি ও একদম সহজ। আলু পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এর থেকে ছোট ছোট চারা বের হয় যা দিয়ে নতুন আলুর চাষ সম্ভব। এছাড়া ও আলু গাছের ডাল কেটে লাগালেও নতুন গছ পাওয়া যায়।
রোগ বালাই নেই বললেই চলে যার কারণে ফলনে সার কিংবা অন্যান্য খরচাপাতি ও কম, কারণ জৈব সারে ই এর প্রয়োজন মিটে যায়। আর যেহেতু খরা সহ্যের ক্ষমতা আছে এই ফসল এর তাই সেচ ব্যবস্থার তেমন দরকার পরেনা তাই সব দিকে ই সেফ এই আলু চাষ করা। একেবারেই নতুন ফসল হিসেবে দাম ও তুলনামূলক ভাবে বেশি ফলে খুব ই ব্যবসাসফল একটি কৃষিপণ্য।।
মিষ্টি আলু নরমালি আমরা সিদ্ধ করে খাই কিংবা পুড়িয়ে ও খাই। কিন্তু এই পার্পেল আলুর আইটেম হতে পারে বিভিন্ন রকম এর। নরমাল মিষ্টি আলুর চেয়ে সিদ্ধ হতে বেশি সময় লাগলে ও খুব সুস্বাদু এ আলু খেতে এবং খাওয়া যায় বিভিন্ন উপায়ে ও।
◑খাওয়া যায় সালাদ হিসবে
◑খাওয়া যায় ভেজিটেবল স্যুপ হিসেবে ও
◑ফ্রাই হিসেবে ও খাওয়া যায় এবং
◑বিভিন্ন বেকড আইটেম এ ও খাওয়া যায়।।।
◑এর চিপ্স ও অনেক মজার।
বেগুনি মিষ্টি আলু সিজনাল হলেও উন্নত বিশ্বে এর প্রক্রিয়াজাত করে রাখা হয় পাউডার ফর্ম এ যা সারাবছর এর চাহিদা মেটায়। পুষ্টির দিক বিবেচনা করেই দিন দিন পার্পেল আলুর আটার চাহিদা বাড়ছে এবং খাবার এ ও ভ্যারিয়েশন আসছে। বেগুনি আলুর টোস্ট, কুকিজ, রুটি, এ আলুর অ্যানহাইড্রাস কেক জায়গা করে নিচ্ছে নিত্যদিনের খাবার এর তালিকায়।
পাশাপাশি পানীয় ও তৈরি হচ্ছে। এ মিষ্টি আলুর দুধ চা এবং সোমিল্ক অনেক বেশি উপকারী পানীয় বলেই আক্ষায়িত করেছেন গবেষকরা।
পুষ্টি উপাদানে ও সেরা এ আলু। একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত পুষ্টিবিদ ড. আবু রায়হান জানান, বিশ্বে ৪০০ রকমের আলুর মধ্যে এ জাতের আলুর পুষ্টিগুণ সবথেকে বেশি।
◑বেগুনী জাতের এ মিষ্টি আলু পটাশিয়াম এবং ফাইবার এর খুব ভালো উৎস। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেটস, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, খনিজ।
◑গ্লাইসেমিক সূচক একদম কম, যার কারণে ডায়বেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব উপকারী একটা আইটেম হতে পারে।
◑নিয়মিত ডায়েট এ যদি বেগুনি রঙ এর আলু থাকে তবে তা রক্ত জমাট বাধার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
◑বেগুনি রঙ এর আলুতে ফাইবার এর উপস্থিতি হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক হওয়া এসব কমিয়ে দেয়।
◑এর মাঝে বিটা ক্যারোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর উপস্থিতি ক্যান্সার প্রতিরোধে বেশ ভূমিকা রাখতে পারে এবং শরীরের ইমিউনিটি বাড়ায়।
◑অনেকের ধারণা রাসায়নিক কোন পদার্থ ব্যবহার করে এর রঙ পরিবর্তন করা হয়৷ কিন্তু ধারণা একেবারেই ভুল৷ এর রঙ একেবারেই প্রাকৃতিক৷ যার কারণে বেগুনী রঙ এর এই আলু থেকে ফলের জ্যুস, আইসক্রিম, ভিটামিন ওয়াটার এবং রঙীন দই হতে পারে, যা শতভাগ প্রাকৃতিক রঙ এর দিক থেকে।
আলু যেমন আমাদের জন্য উপকার তেমনি আলু তোলার পর এর ডালপালা গবাদি পশুর জন্যও অনেক বেশি উপকারি।
মধুপুর এ কৃষিপণ্য নাম আসলেই যে একজন উদ্যোক্তার কথা উঠে আসে তিনি হলেন মোঃ ছানোয়ার হোসেন। আমেরিকা ফেরত এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনি এই চারা সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর গবেষক প্রফেসর ড.আব্দুর রহিম স্যার এর কাছে থেকেও তিনি চারা এনেছেন। অবাক হলেও সত্যি যে তার কাছে শুধু পার্পেল না আছে ইয়েলো পটেটোর চারা ও।
প্রতি হেক্টর এ তিনি ফলন পাচ্ছেন ৪৮ থেকে ৫০ টন্যা প্রচলিত নরমাল মিষ্টি আলুর তুলনায় ৫ থেকে ৮ টন বেশি। প্রতি আলুর ওজন ও বেশি আলহামদুলিল্লাহ।
টাংগাইল পুরো জেলাটা ই কৃষি পণ্যে ভরপুর। এর মাঝে মধুপুর একেবারেই কৃষিপণ্যে অনেক বেশি সম্ভাবনাময়, এটা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। যে কেউ চাইলে এই জায়গা টা কে কাজে লাগাতে পারে ই-কমার্স এর হাত ধরে। তাছাড়া পার্পেল আলুর এত পুষ্টিগুণ, উৎপাদন খরচ একেবারেই সীমিত এবং ই-কমার্স এর আওতায় একে আনতে পারলে তা পুরো দেশে ডেলিভারি দেয়াটাও খুব সহজেই সম্ভব হবে কেননা এটি দ্রুত পচনশীল নয়। শুধু দেশ না বাহিরের দেশে এর ব্যাপক চাহিদা যা আমাদের দেশে উৎপাদন বাড়লে অবশ্যই রপ্তানিযোগ্য পণ্য হবে। শুধু এগিয়ে আসতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে, পণ্যের কন্টেন্ট বাড়ানোর ক্ষেত্রে মন দিতে হবে, সকলের সামনে সেগুলো প্রেজেন্ট করার চেষ্টা করতে হবে৷ জানলেই তৈরি হবে উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা এবং পুষ্টিগুণ বিবেচনায় আগ্রহী হবে ক্রেতা।