সেই আঠারো শতকে স্কটিশ লেখক ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইডের গল্পটা লিখেছিলেন। একই মানুষের দুই সত্তার কাহিনি। একই মানুষের আলো ও অন্ধকারের কাহিনি। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সব জেকিল ও হাইডের দুই চেহারা দেখতে পারলে অনেক সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হতো।
একই মানুষের দুই সত্তার খোঁজ পাওয়া এখন কিছুটা সহজ করে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবনযাপন আর ফেসবুকের জীবনযাপনের মধ্যে ফারাক আকাশ-পাতাল। অনেকেরই ফেসবুকের ভালো মানুষের চেহারাটা খসে পড়ে বাস্তব জীবনে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ফেসবুকই আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষের দুই চেহারার অসংখ্য কাহিনি।
কক্সবাজারে এক নারী পর্যটক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আট মাসের সন্তানকে নিয়ে স্বামীসহ তিনি গিয়েছিলেন কক্সবাজার। তারপরও নিরাপদ থাকতে পারেননি তিনি। সৈকতে নামতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিই হচ্ছে ঘটনার সূত্রপাত। অভিযুক্ত তিনজনকেই শনাক্ত করা গেছে। পুলিশ বলছে, প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম আশিকুল ইসলাম, তিনি কক্সবাজার পৌরসভার বাহারছড়া এলাকার একজন সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই, নারী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে ১৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাই মামলায় তিনি জেল খেটে বের হয়েছেন ৮ ডিসেম্বর। এই হচ্ছে ‘মিস্টার হাইড’ আশিকুল ইসলামের এক চেহারা।
এবার দেখা যাক আশিকুল ইসলামের ‘ডক্টর জেকিল’ চেহারাটা কেমন। এ জন্য যেতে হবে তাঁর ফেসবুকের পাতায়। শুরুতেই বলে রাখি, চলতি বছরের ২৯ নভেম্বরের পরে আশিকুল ইসলামের ফেসবুকে কয়েক দিন কোনো স্ট্যাটাস ছিল না। এরপর তিনি আবার ফেসবুকে সক্রিয় হন ১৮ ডিসেম্বর। কারণটা এখন সবার জানা। কেননা এই সময়ে তিনি ছিনতাই মামলায় জেলে ছিলেন।
ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাস অনুযায়ী, আশিকুল ইসলাম অত্যন্ত বন্ধুবৎসল একজন মানুষ, উপকারী ও প্রচণ্ড ধার্মিক। জীবনকে সুন্দর রাখার নানা ধরনের উপদেশ বাণী আছে অনেকগুলো স্ট্যাটাসে। যেমন গত ২৮ মে তিনি নিজের একটি ছবি দিয়ে সেখানে লিখেছেন, ‘জীবনটাকে সুন্দর করতে হলে, দুষ্টু লোকের ছায়া থেকেও দূরে থাকতে হবে। না হলে….(এরপর তিনি চারটি ইমোজি ব্যবহার করেছেন।)’ শেষ বিচারে দুষ্টু লোকটি যে আসলে নিজেই, কথাটা লিখে দিলেই ভালো হতো।
আবার গত ১৭ এপ্রিল দেওয়া স্ট্যাটাসে আশিকুল ইসলাম লিখলেন, ‘বিদেশে যাইতে লাগে বিমান, আর জান্নাতে যাইতে লাগে পারফেক্ট ইমান।’ মহামূল্যবান বাণী, কিন্তু নিজেই সেটা মানতে পারলেন না। এরপরের বাণীসংবলিত স্ট্যাটাসটি ১৪ এপ্রিলের। গোল টুপি পরে শ্মশ্রুমণ্ডিত আশিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘জীবনটাকে রোজার মতো করে কাটাও, মৃত্যুটাও ঈদের মতো লাগবে।’
গত এপ্রিলে আশিকুল ইসলাম ফেসবুকে তিনটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। যেমন ১৪ এপ্রিল লিখলেন, ‘সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে চেনা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে উপদেশ দেয়া।’ আসলেই, কত সহজ করেই না নিজের কথা এভাবে লিখলেন অভিযুক্ত আশিক। ৭ এপ্রিল আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে লিখলেন, ‘সুন্দর একটা পৃথিবী চাই, মুসলমান আমরা ভাই ভাই।’ এমন একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, অথচ পৃথিবী অসুন্দর করতে তাঁর চেষ্টার কোনো কমতিই নেই।
গত ২০ জুন আশিকুল ইসলাম ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘অতীতের সবকিছু ভুলে, সৎ পথে থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মহান আল্লাহর নামে শুরু করলাম, আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই।’ ২৭ জুন তিনি দোয়া চেয়ে আবার লিখলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের একটা অতীত থাকে, আমারও একটা অতীত ছিল, আমি আর সেটা নিয়ে একটুও চিন্তা করতে চাই না, এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই, সকলের সহযোগিতা এবং দোয়ার আর্জি প্রার্থনা করছি।’ এসব স্ট্যাটাসের মন্তব্যের ঘরে তাঁকে দোয়া করার কেউ যে ছিল না, তা নয়; কিন্তু কাজ যে হয়নি, তা দেখাই যাচ্ছে। কেন কাজ করল না, এর ব্যাখ্যা হতে পারে তারই দেওয়া আরেক স্ট্যাটাস। গত ২১ নভেম্বর তিনি লিখেছিলেন, ‘হারাম থেকে বেঁচে থাকো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবে!’ অর্থাৎ হারাম থেকে বেঁচে থাকতে না পারলে হেফাজত যে হবে না, সেটা তো তিনি জানতেন।
কক্সবাজারের সাংসদ সাইমুম সরওয়ারের সঙ্গে আশিকুল ইসলামের সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল, তা অবশ্য ফেসবুক থেকে বোঝা গেল না। কেননা তাঁর সঙ্গে ছবি মাত্র একটি। তবে সাংসদের জন্য যে তিনি প্রাণ ভরে দোয়া করেছেন, তা পরিষ্কার। গত ২৫ জুন তিনি সাংসদের এক পাশে দাঁড়ানো ছবিসহ স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছেন, ‘হাজারো মানুষের দোয়া আছে বিদায় (বিধায়) আপনি এখনো সুস্থ আছেন। আপনার দীর্ঘ আয়ু এবং সুস্থতা কামনা করি। সবাই মাননীয় এমপি মহোদয়ের জন্য দোয়া করবেন।’
কক্সবাজারের ঘটনার কারণে আশিকুল ইসলামের ফেসবুকের পাতা এখন ফেসবুকবাসীর জন্য একটি দর্শনীয় জায়গা। ফলে সেখানে অসংখ্য মানুষ এসে মন্তব্য করছেন। বলাই বাহুল্য, সেসব মন্তব্যের বেশির ভাগই প্রকাশযোগ্য নয়। তবে সবাই শাস্তি চেয়েছেন, এটা বলা যায়।