ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহানা শিউলি। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে বাধ্য হয়ে চলে যান গ্রামের বাড়ি। তার বাড়ি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কুশদ ইউনিয়নের আফতাবগঞ্জে। এটি একটি প্রান্তিক জনপদ।
বাসায় থাকাকালে অনলাইনে পাঠদান শুরু হলে শুরুর দিকে মোবাইল ডাটা কিনে ক্লাস চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু ডাটা কিনে ক্লাস করা তার জন্য ব্যয়বহুল। খোঁজ নিয়ে তিনি তার ইউনিয়নে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ ইন্টারনেটে যুক্ত হন। এরপর থেকে কম খরচে, দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে অনলাইন ক্লাস করছেন শিউলি।
নুরজাহান বেগম পেশায় একজন গৃহিনী। দুর্গম পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মহীন দরিদ্র পাহাড়ি নারীদের দিয়ে শীতের চাদর ও জামা বুনে জেলা শহরে নিয়ে বিক্রি করেন। ইউনিয়ন থেকে জেলা শহরে আসা-যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হওয়ায় প্রতি সপ্তাহে একবার কাপড় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতেন তিনি। এতে করে সপ্তাহে তার মোটামুটি ডজনখানেক শীতের চাদর বিক্রি হতো। আর এই অর্থ দিয়ে সংসার চালাতে বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছিল নুরজাহান বেগমকে। একসময় বান্ধবীর কাছে আইডিয়া নিয়ে পণ্যের ছবি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করতে লাগলেন। এতে অবশ্য কষ্ট লাঘব হয়েছে তার। এখন আর সপ্তাহান্তে পণ্য বিক্রি করতে জেলা শহরে যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসেই তিনি তার পণ্য বিক্রির অর্ডার পাচ্ছেন। আগের চেয়ে বিক্রিও বেড়েছে। ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করে প্রতিমাসে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারছেন তিনি। গৃহিনী থেকে ধীরে ধীরে উদ্যোক্তায় রূপান্তরিত হয়েছেন।
শুধু শিউলি ও নুরজাহান নয়, এরকম হাজার গ্রাহক কম খরচে দ্রুত গতির ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট ও ওয়াই-ফাই সেবা পাচ্ছেন গ্রামে বসে। আর তা সম্ভব হয়েছে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’-এর কল্যাণে।
‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ সারাদেশে তাদের ইন্টারনেট ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক দ্রুত গতিতে সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ দেশের সাতটি বিভাগে তাদের ইন্টারনেট সেবা অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে ২৫ জেলার ৩৫ উপজেলায়, ৫৩ ইউনিয়নের ২৪৯টি গ্রামের মানুষ ইতোমধ্যে এই নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে।
‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা মোট ১১ কোটি। তবে দেড় দশক আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২ লাখ। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশের অবস্থান গ্রামে। গত দেড় দশকে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকা গ্রামীণ জনপদের মানুষের হাতে সারাদেশে এক আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে কম খরচে, গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে ২০১৭ সাল থেকে কাজ করছে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা থেকে অনেকটাই পেছনে রয়েছে। এছাড়া শহরের তুলনায় গ্রামে ইন্টারনেটের দামও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা কৃষি কাজ করে, ভ্যান চালিয়ে, সবজি বিক্রি করে ইন্টারনেটের এমবি কিনছে তাদের জন্য কিছু করার মনোভাব এবং গ্রামের বেকার তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ কাজ করছে। এজন্য প্রত্যেকটি গ্রামে সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করে গ্রামীণ জনপদে মানুষের হাতে ইন্টারনেট সহজলভ্য করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’।
জানতে চাইলে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’-এর প্রধান নির্বাহী মোবারক হোসেন বলেন, ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সাপোর্ট। আপনি সংযোগ নিলেন কিন্তু সমস্যা দেখা দিলে যে সাপোর্ট প্রয়োজন এই সাপোর্ট সেন্টার যদি প্রত্যেকটি গ্রামে স্থাপন করতে পারি তাহলে এ সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশে ৬৮ হাজার ৩৮টি গ্রাম আছে। প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে গ্রামপ্রতি আমাদের তিন থেকে পাঁচজন লোকবল প্রয়োজন। এ লোকবল ঢাকা থেকে নিয়োগ দেওয়া ব্যয়বহুল।
তিনি বলেন, কুমিল্লা শহরে ২০১৭ আমরা একটি গবেষণাধর্মী প্রজেক্ট চালু করি। সেখানে আমরা পর্যালোচনা করে দেখলাম কী হলে মানুষের উপকার হয়। আমরা দেখলাম এই যে ব্রডব্র্যান্ড ইন্টারনেট, এটির যে ওয়াই-ফাই সংযোগ আছে, একজন গ্রাহক তার বাসা থেকে বের হলে তা আর কোনো কাজে আসে না। বাধ্য হয়ে তার মোবাইলে ডাটা অন করতে হয় অথবা যেখানে যান সেখানে কোনো পরিচিতজনের কাছ থেকে তার পাসওয়ার্ড চেয়ে নিতে হয়। এতে করে দু’ভাবে খরচ হয় একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর। আমরা চিন্তা করলাম এ বিষয়টিকে কীভাবে সাশ্রয়ী ও সহজীকরণ করা যায়? তখন আমরা একটি প্রযুক্তি ডেভেলপ করলাম এবং এর মাধ্যমে একজন গ্রাহক বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একই পাসওয়ার্ড ও আইডি ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে সর্বত্র নেটওয়ার্কে যুক্ত থেকে কাজ করতে পারবেন। কম খরচে মানুষ ৯৯ টাকায় ৬০০ জিবি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। তাছাড়া ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’-এর রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া খুবই সহজ। আমরা গ্রামের বাজারের মধ্যে একটি ওয়াই-ফাই জোন তৈরি করছি এবং এই গ্রামে যে কেউ স্মার্টফোন নিয়ে প্রবেশ করলে তার মোবাইলে ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ এর নটিফিকেশন আসে। তখন গ্রাহক তার মোবাইল নম্বর ব্যাবহারর করে পছন্দসই প্যাকেজ অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে কিনে রিচার্জ করে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন।
মোবারক হোসেন বলেন, গ্রামাঞ্চল সাধারণত বাজারকেন্দ্রিক হয়। আমরা প্রথমে বাজারটিকে কাভার করি। তারপর পাড়াগুলোকে কাভার করি। এভাবে আমরা পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি গ্রামকে পুরোপুরি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসবো। এ কারণে আমরা প্রতিটি গ্রামে একটি করে সাপোর্ট সেন্টার করছি। ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ গ্রামীণ জনপদে শুধু একটি ইন্টারনেট সেবাই দিচ্ছে তা নয়। গ্রামে ভালো মানের ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি বেকার তরুণদের কর্মসংস্থান এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য ফ্রি প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
‘ভালো মানের ইন্টারনেট সেবা সব গ্রাহকদের প্রত্যাশা। শহরের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ৫০০ টাকা খরচ করে যে গতির ইন্টারনেট সেবা পায়, অপরদিকে যারা গ্রামে থাকে তারা কিন্তু সমপরিমাণ টাকা খরচ করেও একই গতির ইন্টারনেট সেবা পায় না। ‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’-এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে নিজস্ব ইন্টারনেট সাপোর্ট সেন্টার থাকবে এবং এ সাপোর্ট দেবে ওই গ্রামের প্রশিক্ষিত তরুণরাই। এতে করে প্রতি গ্রামে কম পক্ষে পাঁচজনের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। প্রত্যেক গ্রামে পাঁচজন করে তরুণ প্রশিক্ষিত করলে ৩ লাখ ৪০ হাজার তরুণের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এছাড়া স্বাধীন ওয়াই-ফাইয়ের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে ১০ জন ফ্রিল্যান্সার তৈরি করে ৬ লাখ ৮০ হাজার তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজের অবারিত সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অনলাইনে ঘরে বসে একজন ফ্রিল্যান্সার ইউরোপের বাজার থেকে একটি প্রোডাক্ট কিনে আমেরিকার বাজারে বিক্রি করছে। এজন্য তাকে ইউরোপ বা আমেরিকায় যেতে হচ্ছে না, শুধু কমিউনিকেশন্স স্কিল থাকলেই হয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তরুণদের ট্রেনিং দিয়ে থাকি।’
ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ইন্টারনেট কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বহির্বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে। আমরা এটি ব্যবহার করছি। আমরা ব্যবহৃত হচ্ছি কিন্তু উপার্জন করছে তারা। টাকা তাদের হাতে চলে যাচ্ছে। আমাদের পরিকল্পনা হলো, এর নিয়ন্ত্রণ আমাদের দেশে থাকতে হবে। আমরা কিন্তু মানুষকে কেবল ইন্টারনেটে সংযুক্তই করছি না, পাশাপাশি এর ভালো দিক এবং খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে গ্রাহকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একজন মানুষ যদি হাতে একটি ছুরি পায় তখন এটি দিয়ে সে ফলও কাটতে পারে অন্যদিকে এ ছুরি দিয়ে মানুষের ক্ষতিও করতে পারে। নির্ভর করে ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
ওয়াই-ফাই প্রযুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওয়াই-ফাই ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে ১৫০ মিটার। আমরা একটি বাজারে দু’টি এন্টেনা স্থাপন করছি। এতে করে ওই যায়গায় ৩০০ মিটারের একটি রেডিয়াস তৈরি হচ্ছে। এই ৩০০ মিটারের মধ্যে একসঙ্গে ৫০০ জন গ্রাহক স্বল্প খরচে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে।
‘স্বাধীন ওয়াই-ফাই’ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মোবারক হোসেন বলেন, আমরা প্রথমে বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, নেটওয়ার্কের যে অবকাঠামো বাংলাদেশ সরকার তৈরি করেছে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবা গ্রামীণ জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১০ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।