২৮ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু হয়েছে দেশের প্রথম ভার্চুয়াল মিউজিয়ামের। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ডিজিটালি সংরক্ষণ করার চিন্তা থেকেই এই জাদুঘর তৈরি করেছেন আহমেদ জামান সঞ্জীব ও তাঁর দল। ভবিষ্যতে সাড়ে চার শর বেশি স্থাপনা যুক্ত হবে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির পর্দায়।
ভার্চুয়াল মিউজিয়াম কী?
ভার্চুয়াল মিউজিয়াম হচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করে তৈরি করা এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে থ্রিডি কিংবা সিক্সডি ফ্রিডম ব্যবহার করে প্রত্নতত্ত্বগুলো আগেরকার রূপে দেখা যাবে।
ডিজিটাল মিউজিয়ামের এই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হেডসেট পড়তে হবে। সিমুলেশনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে সশরীরে জাদুঘর ঘুরে দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
অবশেষে পাঁচ বছর পর
২০১৭ সালে সস্ত্রীক পানামনগরে ঘুরতে গিয়েছিলেন আহমেদ জামান সঞ্জীব। সেখানকার প্রাচীন সেই প্রত্নতত্ত্ব সম্পদগুলোর জীর্ণদশা দেখে হঠাৎ করে সঞ্জীবের মাথায় এলো ভার্চুয়াল রিয়ালিটির (ভিআর) কথা। যদি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি মাধ্যমে সিমুলেশন বা ত্রিমাত্রিক পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে দেড় শ বছর আগের পানামনগর কেমন ছিল সেটিও দেখানো যাবে, পাশাপাশি এটির প্রামাণ্যচিত্রও সংরক্ষণ করা যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এরপর তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা অনি।
শুরুতে পানামনগর নিয়ে কাজ করতে চাইলেও পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ দিয়ে শুরু হয় কাজ। বিভিন্ন টিউটরিয়াল দেখে টেকনিক্যাল কাজগুলো সম্পন্ন করেন সঞ্জীব। পাঁচ বছরের মাথায় ভার্চুয়াল জাদুঘরে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ছয়টি স্থাপনার ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) প্রদর্শন দেখা যাবে। স্থাপনাগুলো হলো—ষাট গম্বুজ মসজিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনা মসজিদ, সোনারগাঁর বড় সর্দারবাড়ি, পানামনগর, দিনাজপুরের কান্তজির মসজিদ এবং যশোরের ১১ শিবমন্দির।
গেমিং ইঞ্জিনে ভার্চুয়াল মিউজিয়াম
‘ভার্চুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশ’ পুরো প্রজেক্টটি গেমিং ইঞ্জিনে তৈরি করা হয়েছে। এ জন্য তাঁরা ব্যবহার করেছেন ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। গেমিং ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আনরিয়েল ইঞ্জিন। ফলে ভার্চুয়াল মিউজিয়ামটি বানাতে টাকা দিয়ে কোনো সফটওয়্যার কিনতে হয়নি। তাঁরা কোনো ধরনের কপিরাইট, লাইসেন্সিংয়ের কোনো জটিলতায় পড়তে চাননি বলেই এই সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন। কেউ চাইলে গেম ইঞ্জিনটিকেও মডিফাই করে নিতে পারবেন। ভার্চুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশে ব্যবহার করা আনরিয়েল গেমিং ইঞ্জিনটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উঁচুমানের গেমিং ইঞ্জিন। গেমিং ইঞ্জিনে শুধু যে গেমিংয়ের কাজ করা যায় তা কিন্তু নয়, এখানে প্রডাক্ট ভিজ্যুয়ালাইজেশন, সিমুলেশনও করা যায়। সিমুলেশন হচ্ছে ধরুন, আপনি মহাকাশে রকেট পাঠাবেন, রকেট পাঠানোর আগে আপনি হয়তো ভিজ্যুয়াল করতে চাইবেন বা দেখতে চাইবেন আকাশে আপনার রকেটটি কিভাবে যাবে। মোদ্দাকথা আপনি যা যা পরিকল্পনা বা ডিজাইন করেছেন সেগুলো করে আকাশে রকেটটি উড়বে কি না তা দেখতে পারবেন। আর এটা দেখার জন্যই আপনাকে কাজটি করতে হবে গেমিং ইঞ্জিনে। প্রথমে আপনি নানা রকম ডাটা বা তথ্য দেবেন এবং পরে সেই অনুযায়ী আউটপুট দেখতে পাবেন।
ভার্চুয়াল মিউজিয়ামটির মডেলিং করা হয়েছে ব্লেন্ডার সফটওয়্যারে। এটিও ওপেন সোর্সের মতো বিনা মূল্যের সফটওয়্যার। টেকশেয়ারিং ও লাইটিং চেক করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সাবসট্যান্স টুলস। ভার্চুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশের জন্য তাঁরা প্রথমে ডাটা সংগ্রহ করেন। প্রত্নতত্ত্ব, অনলাইন, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষকদের গবেষণাপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বাছাই করেই সেই ডাটা বা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সিমুলেশন তৈরি করা হয়েছে। প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটা প্রাথমিক ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করা হয়। এরপর আবার চূড়ান্তভাবে ডাটার ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তন কিংবা সংযোগ করা হয়। ভার্চুয়াল মিউজিয়মের পুরো কাজটি করতে তাদের কয়েকবার পুরনো সেই স্থাপনাগুলোতে যেতে হয়েছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে ভিডিও ফুটেজ।
ভিআরে জাদুঘর
ভিআর হেডসেটে পড়ে জাদুঘরটি দেখলে মনে হবে যেন সশরীরেই দেখছেন। আমরা সাধারণত যে ধরনের ভিডিও দেখে থাকি তা ৫০ এফপিএসে চলে থাকে। কিন্তু ভিআর হেডসেটে যখন জাদুঘরটি দেখি তখন সে ভিডিওটি চলে কমপক্ষে ৭৫ এফপিএসে। কেউ যদি তাঁর কম্পিউটার বা ল্যাপটপে ডিজিটাল জাদুঘরটি দেখতে চান, তাহলে ভালো গ্রাফিকস কার্ড থাকতে হবে। এ ধরনের ভালো গ্রাফিকস কার্ডযুক্ত ডেস্কটপের দাম পড়বে এক লাখের ওপরে এবং ল্যাপটপের দাম পড়বে এক লাখ ২০ হাজারের ওপরে। আর হেডসেটটি পাওয়া যাবে এক হাজার ৫০০ টাকায়।
অ্যাপে জাদুঘর
ভার্চুয়াল মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট (https://www.virtualmuseumbd.com/) থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে। এখন শুধু বেটা সংস্করণটি রয়েছে। ভিআর দুই রকমের। একটি হলো থ্রি ডিগ্রি অব ফ্রিডম ভিআর। এটি ব্যবহারে তিনটি ডিগ্রিতে নড়াচড়া করে এই জাদুঘরে থাকা বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরেফিরে দেখা যাবে। অন্যদিকে সিক্সডি অব ফ্রিডমে ছয় ডিগ্রি অব ফ্রিডম পাওয়া যাবে। এটি ব্যবহার করা হলে ত্রিমাত্রিকসহ ওপরে-নিচে অর্থাৎ সব দিকেই নাড়াচাড়া করা যাবে। এর ফলে সিমুলেশন পরিবেশে চাইলে ঘুরে বেড়ানোও যাবে। এ সুবিধা থ্রিডিতে পাওয়া যায় না। সিক্সডি ফ্রিডম ব্যবহার করার ফলে পুরনো এই স্থাপনাগুলোর কক্ষগুলোতেও ঢোকা যাবে। যেহেতু ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয়নি, ফলে এখন কক্ষগুলোর ভেতরে তেমন কিছু দেখা যাবে না। ডিজিটাল মিউজিয়াম বাংলাদেশের থ্রিডি ফ্রিডম ভিআরটি মোবাইলের জন্য রয়েছে। এটিতে খরচ কম। আর মোবাইল থেকে সহজেই ভিআর হেডসেটের মাধ্যমে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করা যাবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেড় শ থেকে তিন শ বছর আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনটাই দেখা যাবে। তবে সেখানে কোনো ক্যারেক্টার, যেমন মানুষ সংযুক্ত নেই। তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এখানে মানুষ, তখনকার যানবাহন, আসবাবপত্র, পোশাক এবং পারিপার্শ্বিকতা যুক্ত করার। এ ছাড়া ৪৫২টি স্থাপনা নিয়ে কাজ করতে চান তাঁরা। আহমেদ জামান সঞ্জীব বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা এই প্রজেক্টকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। সেখানে নিয়ে যেতে হলে আমাদের কিছু গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে। আর আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। ’