বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ বা পাবলিক গ্রুপ খুলে গুগল প্লের অ্যাপস এর মাধ্যমে অনলাইনে লোভনীয় অফারে প্রচার করা হচ্ছে নানা রকম জুয়া ও গেইম খেলার বিজ্ঞাপন। খেলোয়ারা দিনে দিনে কোটিপতি হয়ে যায় বলেও প্রচার করা হয় এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশের নামি-দামি গণমাধ্যমের লোগো এবং মন্ত্রীদের ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে একদিকে টাকার নেশা ও অন্যদিকে খেলার নেশায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ও ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে যুব সমাজ। অচিরেই এস বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে এই পরিস্থিতি আরো মারাত্ম আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
দেশের বেশ কিছূ স্যাটালাইট টেলিভিশন ও বেশ কিছূ সুপরিচিত ইউটিউভ চ্যানেলে চলছে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন (টিভিসি)
ফেসবুকে প্রবেশ করলে দেখা যাচ্ছে নানা কৌশলে লোভনীয় অফারে মানুষের মনকে খেলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। কখনো দেখা যায় এনটিভি ও সময় টেলিভিশন সহ কিছু চ্যানেলে এসব খেলায় প্রচুর অর্থ পেয়েছেন মর্মে ভুয়া খবর প্রচার করা হচ্ছে। একইভাবে দৈনিক প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, যুগান্তর, সমকালসহ বিভিন্ন বহুল প্রচলিত পত্রিকার লোগো ব্যবহার করে লোভনীয় খবর প্রচার করে খেলায় অংশ নেওয়ার আহবান জানাচ্ছে। এসব অফারের বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর ছবি লাগিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থের লোভ ও নেশার কবলে এসব অফারে আকৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থী ও যুবসমাজের অনেকেই তাদের অফারে পা দিয়ে সর্বশান্ত হওয়ার মত ঘটনা ঘটছে।
এসবিএন নামের একটি অ্যাপস থেকে বিভিন্ন কৌশলে কোট কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর এই বিষয়ে চট্টগ্রামে একটি মামলাও করেছে ভুক্তভোগী শাহাবুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি।
ভুুক্তভোগী সাংবাদিক বিশ্বজিত দাশ নামের এক ব্যক্তি জানান এসব অ্যাপস এর মাধ্যমে প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে কয়েকটি চক্র। আমি নিজেও লাভের আশায় অংশ নিয়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা হারিয়েছি। বিগ উইন নামের একটি পেইজে সাকিব আল হাসানের ছবি দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম আইনি ক্যাসিনো দাবী করে ২শ টাকা জমা করলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা জানানো হয়।
অনলাইনে জুয়া : সাকিবের সাথে কঠিন, টি-স্পোর্টসের সাথে নরম
লাক অন ডাক নামের একটি পেজে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেনের ছবি এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে মনে হয় দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপানো হয়েছে এবং সেই সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন তাৎক্ষণিক ১০ হাজার টাকা পাওয়া ২০২২ সালে খুব সহজ হয়ে গেছে। ফোন অ্যাপসটি দুর্দান্ত গতি পেতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ডাউনলোড করেছে। এমনকি প্রথম দিনেই সবাই ৫ হাজার টাকা পেতে সক্ষম।
দৈনিক ইত্তেফাকের লোগো এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর ছবি দিয়ে বলা হয়েছে আমি সব বাংলাদেশিদের এই গেইম সাজেস্ট করি। এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তিনি আশ্বাস দেন যে এই গেমটিতে কোন ঝুঁকি নেই। আপনি সহজেই আপনার কার্ডে প্রতি মাসে ১০০,০০০ টাকা পেতে পারেন। আর এজন্য একটি লিংক ফলো করার কথা বলা হয়েছে।
এব্যপারে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম বলেন, অনলাইন বা অফলাইন কোন অবস্থাতেই জুয়া বা ক্যাসিনো খেলার আইনগত কোন বৈধতা আমাদের দেশে নেই। তবে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র অন লাইনে এসব বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আমি আশা করব সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আরো সচেতন হয়ে এসব অপকর্ম ঠেকাতে আইনি যথাযথ পদক্ষেপ নিবেন।
এ ব্যাপারে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি এস.এম. নাজের হোছাইন বলেন অনলাইনে নানা রকম লোভনীয় ও আপত্তিকর বিজ্ঞাপন যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করতে পারে। তবে অনলাইন যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আছে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। সরকারের বিটিআরসি নামক প্রতিষ্ঠানটি কী শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ে ব্যস্ত কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যথাযথ নীতিমালা যেমন দরকার, ঠিক একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদেরকে সচেতন করাও দরকার। মোবাইল অপারেটর ও বড় ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারীরাও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের মাধ্যমে এ ধরনের সচেতনতা বিকাশে এগিয়ে আসতে পারে। আর নীতি নৈতিকতা, দেশপ্রেম বিষয়ে তরুন বয়সেই শিক্ষা নিতে হবে।
তবে বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফেসবুক অনলাইন মনিটরিং করার জন্য সরকারের একটি টিম সার্বক্ষণিক কাজ করে। ফেসবুকে কে কি পোস্ট করছে তাও মনিটরিং করছে কিন্তু এধরণের একটা প্রতারণা কিভাবে তাদের চোখকে ফাঁকি দেয় তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমি আশা করব শিক্ষার্থী ও যুব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা ও বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে এক্ষনি এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
এব্যপারে মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন প্রতারণা থেকে বাঁচতে ব্যবহারকারীদের সচেতনতা খুবই জরুরী। গুগল প্লে স্টোরে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের সংখ্যা ৩২ লাখ। এছাড়াও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোটি কোটি বিভিন্ন অ্যাপলিকেশন বা অ্যাপ রয়েছে। এ সকল অ্যাপের মধ্যে বেশিরভাগই লোভনীয় এবং প্রতারণামুলক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রতারক চক্র এসব গেইম, জুয়া বা পুরস্কার প্রদানসহ বিভিন্ন লটারির কথা বলে লোভনীয় অফারের ফাঁদ পেতে থাকে। আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর এসব অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এবং তাদের ভিতরে লোভ কাজ করায় প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়। এ সকল অ্যাপ্লিকেশন নিয়ন্ত্রণে এখন অবধি দেশে কোন নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। এরা সরকারের লাইসেন্সধারী কোন প্রতিষ্ঠানও নয়। এসব প্রতারক চক্রের কারণে একদিকে যেমন ব্যবহার কার্যক্রমের মাধ্যমে শীক্ষার্থী ও যুবসমাজ ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছে আবার বিদেশে অর্থ চলে যাওয়ায় রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছি যাতে এধরণের সকল অ্যাপ বা অ্যাপ্লিকেশন চিহ্নিত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এব্যপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রয় মৈত্র বলেন এরকম কিছু পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, এগুলো দেখার জন্য আমাদের একটা মনিটরিং টিম কাজ করছে। আপনার নজরে এলে আমাদের লিংক দিয়ে সহায়তা করতে পারেন, আমরা ব্যবস্থা নিব।