মৌলভীবাজারের মেয়ে রিপা,রুপা।রুপা সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধ্যয়নরত আছে আর রিপা মৌলভীবাজার গ্রীন হিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। ছোটবেলা থেকেই রুপা ইচ্ছে শিক্ষার্থী থাকাকালীন অবস্থায় স্বাবলম্বী হবেন। শিক্ষাজীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছাশক্তি থেকেই বড় বোন রিপা সাথে উদ্যোক্তা হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন রুপা।
তিনি জানান, করোনাকালীন এই সময়ে সবকিছু যখন থেমে যাচ্ছিলো, তখন ই দুইবোন সিদ্ধান্ত নেন থেমে থাকা যাবে না, এখনই সময় আমাদের স্বপ্ন কে সত্যি করার। আমরা যদি আমাদের স্বপ্নকে সত্যি করতে পারি,তাহলে অন্যদেরকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করতে পারবো।
মেয়েদের শুধু ঘরেই থাকতে হবে, একটা জব করলে আর কিছু করা যাবে না,মেয়েরা পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে না,মেয়েরা নিজেরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না,এইসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা ছিল সব সময় আমাদের। এই উদ্যোগেই নিজের পেইজ “শখের বিক্রেতার” যাত্রা শুরু করি। উই তে আমরা জয়েন করি ৪জুলাই,২০২০। তার ৮০তম দিনেই আমরা উই তে লাখপতি হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। এখন পর্যন্ত উই তে আমাদের সেল ১,৬২,৫৮০টাকা,উইসহ আমাদের মোট সেল হয়েছে ২,৩৬,৭৭০ টাকা।
মনিপুরী জাতি :
মনিপুরী জাতি বাংলাদেশে বসবাসরত একটি নৃ-গোষ্ঠীর নাম।এদের আদি বসতি ভারতের মনিপুর রাজ্যে। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দেড় লক্ষেরও বেশি মনিপুরী বসবাস করে। মনিপুরী নারীরা ঘরে বসে তাঁতে কাপড় বুনন করে থাকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য। প্রায় ঘরেই একটা সময় তাঁত ছিল, বর্তমানে কমে গেলেও অনেকেই তাদের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।সাধারণত মনিপুরী নারীরা ই তাঁতের কাজ টা করে থাকে। তাই মনিপুরী মেয়েরা জন্মের পর থেকেই মায়ের কাছ থেকে দেখে দেখে তাঁত বুননের কৌশল আয়ত্ত করে ফেলে। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের প্রায় ৫০/৬০ টি গ্রামে এই তাঁতীরা বসবাস করে। পূর্বে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ মনিপুরী শুধু শাড়ি সহ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহৃত পণ্য তৈরি করতো কিন্তু দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধিও বর্তমানে দেশ বিদেশে মনিপুরী পণ্যের পরিচিতির কারনে মুসলিম নারীরাও এই পেশায় যুক্ত হয়েছে।মনিপুরী যারা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গিয়েছিল তারাও বর্তমানে পুরোনো পেশায় ফিরে আসছে এবং নতুন তাঁত বসাচ্ছে।
মনিপুরী তাঁত শিল্পের ইতিহাস
বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে এদেশের সংস্কৃতি। আর তাঁত শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক। দেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প বা লোকশিল্পও এটি। সিলেট এর মনিপুরী তাঁত শিল্প, এই সর্ব বৃহৎ শিল্পের অন্যতম অংশীদার।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং- এর ভ্রমণ কাহিনীতে মনিপুরী বস্তু শিল্প অর্থাৎ মনিপুরী তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। সে দিক থেকেও বলা যায় মনিপুরী তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন, এটি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। বর্তমানে মনিপুরী তাঁতের শাড়ির জন্যই মনিপুরীদের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী।
বর্তমান মনিপুরী শাড়ির চাহিদা
মনিপুরী শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণ যোগান এবং করোনার কারণে পর্যাপ্ত সুতোর আমদানী না থাকায় তাঁতীরা চাহিদার তুলনায় শাড়ি যোগান দিতে পারছে না এতে শাড়ির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন কিছু কারন আমার চোখে পরেছে কারন আমার শাড়ি সংগ্রহ করতে তাঁতিদের বাড়িতে যেতে হয়।একটাসময় তাঁতিদের ঘরে শাড়ি জমপ থাকতো কারণ নেয়ার মতো লোক ছিলো না।তখন আমাদের বার বার ফোন দিয়ে জানতে চাইতো কবে আমরা শাড়ি আনতে যাবো পাশাপাশি শাড়ি বিক্রি না হওয়ার কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে সেই দুঃখ প্রকাশ করতো।একটা ভালো মানের শাড়ি তৈরি করতে সময় লেগে যায় ৭-১৪ দিন,পরিশ্রম আর সময়ের তুলনায় শাড়ির মূল্য সত্যিই তেমন কিছু না।
মনিপুরী শাড়ির বৈশিষ্ট্য
শাড়িগুলোর জমিনের তুলনায় পাড়ের রংটা গাঢ় হয়,তাই দূর থেকে নজর কাড়ে। শাড়ির টেম্পেল পাড় তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আবার শাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শাড়িগুলো সম্পূর্ণ হাতে বুনন করা হয়,হাতে বুনন করায় শাড়িগুলোর এপিঠ-ওপিঠের কোনো পার্থক্য থাকে না,উভয় পিঠই সমানভাবে ব্যবহার করা যায়।মনিপুরী শাড়িগুলোর কাজের ডিজাইন কখনোই একটার সাথে অন্যটার মিল থাকে না কারণ শাড়িগুলো তাঁতিরা তাদের মনের মতো করে তৈরী করে,এই শাড়ির কারুকাজের সাথে জড়িয়ে থাকে তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না,দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বাস্তবচিত্র।
মনিপুরী শাড়ি গুলো তৈরিতে মেশিনের কোন স্পর্শ থাকে না সম্পূর্ণ হাতে তৈরী করা হয় বলে শাড়িতে তাঁতের কালো দাগ,মাড়ের সাদা দাগ এবং জাল বুননের হয়ে থাকে। যারা মনিপুরী সম্পর্কে জানে না বা নতুন কিনে থাকে তাদের মনে হয় এগুলো শাড়ির ডিফেক্ট কিন্তু অরিজিনাল মনিপুরী শাড়ির বৈশিষ্ট্য এগুলো।
মনিপুরী শাড়ির যত্ন
মনিপুরী শাড়িগুলো যত্ন নেওয়ারও রয়েছে কিছু নিয়ম যা মেনে চললে একেকটা শাড়ি টিকে থাকে যুগের পর যুগ। যেমন – শাড়িগুলো সাবান না, ডিটারজেন্ট দিয়ে ভিজিয়ে রাখ যায় না সবচেয়ে ভাল হয় শ্যাম্পু বা মাইল্ড ডিটারজেন্ট ব্যবহার করলে অথবা ড্রাইওয়াশ করলে। ধৌয়ার সময় শাড়িগুলোতে ব্রাশ বা বেশি ঘসাঘসি করা যাবে না। ধৌয়ার পর মাড় দিয়ে লম্বা তারে সোজা করে কড়া রৌদে শুকাতে হয় তারপর ইস্ত্রি করে আলমারিতে সংরক্ষণ করতে হয় এভাবে যত্ন নিলে শাড়ি গুলো টিকে থাকে বহু বছর।
লেখক-রিপা ও রুপা
সত্ত্বাধিকারী -শখের বিক্রতা